
মহাদেবপুর দর্পণ, কিউ, এম, সাঈদ টিটো, নওগাঁ, ২৭ এপ্রিল ২০২১ :
প্রাচীন ঐতিহ্যের ছাপ দেদীপ্যমান মসজিদটির পরতে পরতে। নান্দনিক নকশা ও সুনিপুণ নির্মাণ কাজ জানান দেয় মুসলিম ইতিহাসের নান্দনিকতার কথা। এতো সুন্দর ও সুদর্শন একটি মসজিদ এবং শৈল্পিক অবকাঠামো রয়েছে তা অনেকে জানেনও না।
বলছি, ধর্মপুর ভাঙা মসজিদের কথা। এটি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামে অবস্থিত। স্থাপত্যকলা, শিল্প-সৌন্দর্যের আধার ধর্মপুরে ভাঙা মসজিদটি ঠিক কত বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল, এর সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সরজমিনে ওই এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, কোনো এক সময় প্রাচীন মসজিদটির আশপাশে মুসলিম ঘন জনবসতি ছিল। মসজিদের পাশে বিশাল পুকুর থাকায় এখানে প্রাচীন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। আবার কি কারণে তারা মসজিটির আশপাশ এলাকার ছেড়ে অন্যত্র চলে যান সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য আজও কেউ বলতে পারেননি।
এর গঠন পদ্ধতি ও স্থাপত্য কৌশল শিল্পসমৃদ্ধ ও অনন্য। নয় গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মসজিদটির ভেতর রয়েছে চারটি সুদৃঢ় খিলান। দরজা রয়েছে মাত্র একটি। দ্বিতল ভবনের ভেতরে মেহরাব ও দেয়ালে অঙ্কিত রয়েছে বিভিন্ন কারুকাজের ফুলদানি ও ফুল। মসজিদের দেয়ালের গাঁথুনি চার ফুট প্রস্থ, যা চুন ও সুরকি দিয়ে গাঁথা।
প্রাচীন স্থাপত্যকলার সুদৃশ্য মসজিদটি চিকন ইট, চুনচুরকির নির্মিত দেয়ালে এখনো নকশা করা কারুকাজ রয়েছে। চারটি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে নয় গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদের নির্মাণশৈলী মনোমুগ্ধকর। মসজিদটি সিঁড়িসহ প্রবেশ পথ, খোলা চত্বর ও মূল ভবন বা নামাজ ঘর তিনটি অংশে বিভক্ত। বিভিন্ন তথ্য মিলিয়ে মসজিদটির সম্ভাব্য বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে চারশ থেকে পাঁচশ বছর।
কিন্তু অযত্ন অবহেলায় ঐতিহ্য ও গর্বের এই মসজিদ আশির দশক থেকে ধীরে ধীরে ধ্বংস হতে শুরু করেছে। দেয়ালে গাছপালা জেগে উঠেছে। দেখা দিয়েছে বড় বড় ফাটল। নামাজ পড়ার অনুপোযুক্ত হওয়ায় একই স্থানে এলাকাবাসীর উদ্যোগে আরও একটি মসজিদ স্থাপন করা হয়।
মসজিদটির পার্শ্ববর্তী ধর্মপুর পাইকপাড়া মন্ডলপাড়া জামে মসজিদের মুসল্লি মো. আনিছুর রহমান (৮০ ) বলেন, ‘আমার নিজের চোঁখে দেখা মসজিদটি ২০ বছর আগেও অনেক সুন্দর ছিলো। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন প্রাচীন এই মসজিদটি দেখতে। এখানে শুধু দুই ঈদের নামাজ হতো। শেষ ঈদের জামাত ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত হয়। বাপ-দাদার মুখ থেকে শুনেছি ১৯২০ সালে মহা ভূমিকম্পে নয়টি গম্বুজসহ মসজিদটির কিছু অংশ ভেঙে যায়। তারপর থেকেই ভাঙা মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে।’
তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, ‘মসজিদটির একটি দরজার ওপর মূল্যবান কষ্টি পাথরে খোদাই করে আরবি ভাষায় কোরআনের সুরা লেখা ছিলো। মহা মূল্যবান পাথর ৩০-৩৫ বছর আগে কে বা কারা চুরি করে নিয়ে যায়।’
স্থানীয় বাসিন্দা তাইজ উদ্দিন বলেন, ‘এই প্রাচীন মসজিদটি আমার ধারণা মতে তিনশ বছরের পুরাতন হবে। আমার বাপ-দাদারাও সঠিক কবে নির্মাণ হয়েছিল তা বলে যেতে পারেননি। গতবছর সরকারের প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের কিছু লোক এসে গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করেছিল। তারপর আজ পর্যন্ত তাদের আর কোনো খোঁজ খবর নেই। এই মসজিদে আমি নামাজ পড়েছি। মসজিদটি পুনরায় সংস্কার করলে গ্রামবাসীর ভালোই হয়। পাশাপাশি দেশের ঐতিহ্যও রক্ষা পায়।’
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা মহসিন আলী বলেন, ‘আমি আব্বার মুখে শুনেছি, তিনিও বলতে পারেননি কবে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এলাকার যুব সমাজের উদ্যোগে মসজিদটিকে সারা বাংলাদেশের মানুষদের কাছে পরিচিত করতে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ হাতে নিয়েছে।’
স্থানীয় যুবক রেজোয়ান হোসেন বলেন, ‘মসজিদটি প্রতিষ্ঠার সময় কী নাম রেখেছেন তাও কেউ বলতে পারেন না। স্থানীয় কয়েকজন যুবকের উদ্যোগে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ পদ্ধতিতে ২০২০ সালের মসজিদটির দেয়ালে গাছ, শৈবাল, ছত্রাক ও জঙ্গলে ঢাকা ভবনটির বিভিন্ন অংশের যথাযথ নথিভুক্তির জন্য আংশিকভাবে ‘শুষ্ক পরিষ্করণ’ (ড্রাই ক্লিনিং) করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে এ উপজেলার একমাত্র পুরাকীর্তি ঐতিহাসিক প্রাচীন মসজিদটির প্রতি সরকারি বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা ধর্মভীরু মুসলিম বিত্তশালীরা কেউই এটির প্রতি দৃষ্টিপাত করছেন না। ফলে মসজিদটির যে অংশটুকু এখনও অবশিষ্ট রয়েছে, তাও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশবাসীর কাছে আকুল আবেদন প্রাচীন স্থাপত্যকলার সুদৃশ্য ধর্মপুর মসজিদ রক্ষায় সকলেই এগিয়ে আসুন।’
নিয়ামতপুর সরকারি কলেজের প্রভাষক ও ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘নওগাঁর ইতিহাস ঐতিহ্যর অংশ হিসেবে এই মসজিদটি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সরকার এবং প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দ্বায়িত্ব নেওয়া উচিত।’
উপজেলা নির্বাহী অফিসার জয়া মারিয়া পেরেরা বলেন, ‘মসজিদটি সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরকে গ্রামবাসীর স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠিয়েছি। শিগগির এই মসজিদটি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় থাকবে।’
বগুড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক মোছা. নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘আনুমানিক ১৭শ খ্রিস্টাব্দে নয় গুম্বুজ বিশিষ্ট চারটি পিলার ও পশ্চিম দিকে মেহেরাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। যা দেখে মনে হয়, এটি মুঘল আমলের একটি মসজিদের ভিত্তি। নয় গম্বুজ মসজিদটি বর্তমানে জেলায় দ্বিতীয় স্থানে থাকবে। আমরা মসজিদ এলাকা ঘুরে দেখেছি। প্রতœসম্পদ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এটি সংরক্ষণযোগ্য। স্থানীয় লোকজন এবং মুসল্লিরাও এটি সংরক্ষণের পক্ষে মত দিয়েছেন। মসজিদটিকে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করে এর সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনা করার ব্যাপারে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি।’
নওগাঁ জেলা প্রশাসক মো. হারুন-অর রশিদ বলেন, ‘প্রতœতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। মসজিদটি নওগাঁর এবং আমাদের দেশের একটি ঐতিহ্য। এটাকে রক্ষা করা আমাদের সবার দরকার।’
যেভাবে যাবেন
নিয়ামতপুর উপজেলা থেকে মসজিদটি প্রায় ১৫ কি.মি দূরে অবস্থিত। সেখান থেকে রিক্সা বা ভ্যানে করে এই মসজিদে যাওয়া যায়।#