নওগাঁর মহাদেবপুরে শুরু হয়েছে আদিবাসীদের দুদিনব্যাপী কারাম পুজা। সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ১০টায় উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী নাটশাল আদিবাসী পাড়ায় পুজার মূল পর্ব উদ্বোধন করেন মহাদেবপুরের সিনিয়র সাংবাদিক কিউ, এম, সাঈদ টিটো। এসময় জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা অসিত দাস, মহাদেবপুর দর্পণের বার্তা সম্পাদক কাজী সামছুজ্জোহা মিলন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আদিবাসী কিশোরীরা অপরুপ সাজে সেজে নানান ফুল, ফল আর পিঠেপুলির ডালা সাজিয়ে শুরু করে অর্চনা। মহাদেবপুর আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলক উড়াও জানালেন, প্রতিবছরের মত এবারও ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে কারাম উৎসব পালিত হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে আদিবাসী মেয়েরা শালের দাঁতন কাঠি ভেঙে পুকুরে স্নান করে যেসব জমিতে ভাল ফসল হয় সেসব জমি থেকে একটু একটু করে মাটি নিয়ে বাঁশ দিয়ে বোনা ছোট ডালায় ভর্তি করে। তারা জাওয়া গান গাইতে গাইতে ডালার চারিদিকে তিন পাক ঘোরে। এরপর তাতে তেল ও হলুদ দিয়ে মটর, মুগ, বুট ও বিভিন্ন ফসলের বীজ মাখায়। কুমারী মেয়েরা স্নান করে ভিজে কাপড়ে ছোট শাল পাতার থালায় বীজগুলো রেখে সিঁদুর ও কাজলের তিনটি দাগ টেনে দেয়। এর নাম বাগাল জাওয়া। আর ওই মেয়েদের বলা হয় জাওয়ার মা। এরপর টুপা ও ডালাতে বীজ বোনা হয়। বাগাল জাওয়া লুকিয়ে ক্ষেতের পাশে রেখে টুপা ও ডালার জাওয়া নিয়ে কুমারীরা গ্রামে ফিরে আসে। পাঁচটি ঝিঙাপাতা উলটো করে বিছিয়ে প্রতি পাতায় একটি করে দাঁতনকাঠি রেখে বেদি তৈরি করা হয়।
তিনি জানান, সোমবার বিকেলে আদিবাসী পুরুষেরা নানান আচার পালন করে মাদল, ঢোল, করতাল ও ঝুমকির বাজনার তালে তালে নেচে-গেয়ে কারামগাছের (খিল কদম) ডাল কেটে এনে বেদিতে পুতে দেন। কিশোরী মেয়েরা সূর্যোদয় থেকে উপোস থেকে রাতে ফুল, ফলে ভরা নৈবেদ্য সাজিয়ে বেদির চারপাশে বসে পুজা শুরু করে। পুজা শেষে রাতভর চলে আদিবাসী নারী-পুরুষের ঐতিহ্যবাহী নাচ গান। গানে গানে তারা উৎসবের বিষয় ও সমসাময়িক নানান বিষয় তুলে ধরেন। আর সৃষ্টিকর্তার কাছে সুখ, সমৃদ্ধি, ভালবাসা আর ভাল ফসল কামনা করেন।
বয়োবৃদ্ধ আদিবাসী নগেন কুজুর জানান, বিপদ-আপদ ও অভাব-অনটন থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে মূলত এই কারাম পূজা পালন করা হয়। কথিত আছে আদিবাসীদের দুই সহোদর ধর্মা ও কর্মা। ধর্মা কারাম গাছকে পূজা করতেন। কিন্তু কর্মা পুজা করতেন না। কর্মা একদিন পুজার কারাম গাছ তুলে নদীতে ফেলে দেন। এরপর তিনি নানান বিপদ-আপদ আর অভাব অনটনে পড়েন। কর্মা আবার সেই গাছ খুঁজে এনে পুজা শুরু করলে তার অভাব দূর হয়।
আদিবাসী নেতা নরেশ উড়াও জানান, পুজা শেষে উপোস থাকা আদিবাসী কিশোরীরা পাকান পিঠা, চিতুই পিঠা, কুশলী পিঠা প্রভৃতি নানান খাবার নিয়ে পরস্পরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে উপোস ভাঙ্গে। শেষে নিজেদের মধে সংগ্রহ করা চাল, ডালে তৈরি খিচুরি দিয়ে উপস্থিত স্বজন ও অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়।
আদিবাসী নেতা অসিত দাস জানান, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের বাৎসরিক কারাম উৎসব পালিত হলেও এখন মূলত তারা এই উৎসবকে ঘিরে সরকারের কাছে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানান। এছাড়া আদিবাসীদের ভাষা চর্চা ও সংস্কৃতি রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।#