
মহাদেবপুর দর্পণ, কিউ, এম, সাঈদ টিটো, নওগাঁ, ১০ এপ্রিল ২০২১ :
কয়েক দফা বন্যায় রোপা-আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে নওগাঁয়। এর প্রভাব পড়ে বাজারেও। ফলে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বাজারে দাম বেশি হওয়ায় গুদামে ধান ও চাল দেননি কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। এতে অর্জিত হয়নি জেলার ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা।
নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট চালকল ৮০১টি। যেখানে সিদ্ধ চালকল ৭৭৪টি ও আতব চালকল ২৭টি। এর মধ্যে নওগাঁ সদরে সিদ্ধ চালকল ২৫২টি, মহাদেবপুরে ২৮২টি, রানীনগরে ৮০টি, আত্রাইয়ে ৩৪টি, পত্নীতলায় ২২টি, ধামইরহাটে ৩০টি, মান্দায় ২৬টি, বদলগাছীতে ১৯টি, পোরশায় ৯টি, সাপাহারে একটি ও নিয়ামতপুরে ১৯টি। এছাড়া নওগাঁ সদরে আতব চালকল ৯টি ও মহাদেবপুরে ১৮টি।
রোপা-আমন মৌসুমে জেলায় ৩৭ টাকা কেজি দরে সিদ্ধ চালের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২ হাজার ২১৭ মেট্রিক টন ও ৩৬ টাকা কেজি দরে আতব চাল ৩ হাজার ৫ মেট্রিক টন। এছাড়া ২৬ টাকা কেজি দরে ধানের লক্ষ্যমাত্রা বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার ১৭৮ মেট্রিক টন। গত বছরের ৭ নভেম্বরে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। এ বছরের ১৫ মার্চ সংগ্রহ শেষ হয়।
সিদ্ধ চালকল চুক্তিবদ্ধ হয় ২০৬ জন এবং আতব চালকল আটজন। যেখানে লক্ষ্যমাত্রার- সিদ্ধ চাল ৩ হাজার ৫২৫ মেট্রিক টন ও আতব চাল ৩৮৪ মেট্রিক টন এবং ধান ২ দশমিক ৫২০ মেট্রিক টন সংগ্রহ করা হয়।গত ইরি-বোরো মৌসুম থেকে খাদ্য অধিদফতর ধান-চাল সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
তবে গত চারদফা বন্যায় জেলায় রোপা-আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এতে ধান উৎপাদনের পরিমাণ কম হয়। বাজারে দামও ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এ কারণে বেশি দামে ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে খরচ বেশি পড়ে। যেখানে খোলা বাজারে মোটা চালের দাম ছিল ৪০-৪২ টাকা। সেখানে সরকার নির্ধারিত মূল্য ৩৭ টাকা। ফলে লোকসান গুনে গুদামে চাল দিয়েছেন চুক্তিবদ্ধ চালকল মালিকরা।
অপরদিকে কৃষকরা বলছেন, এ বছর বাজারে ধানের দাম ছিল বেশি। প্রতি মণ মোটা ধানের দাম ১ হাজার ২০০ টাকার ওপরে। ২৬ টাকা (প্রতি মণ ১০৪০ টাকা) কেজি দরে কার্ডধারী প্রতিজন কৃষকের বরাদ্দ এক টন। সরকারি নির্ধারিত দামের চেয়ে সামান্য কম হলেও নানা জটিলতায় গুদামে ধান দিতে আগ্রহ দেখাননি কৃষকরা।

মহাদেবপুর উপজেলার তাতারপুর গ্রামের কৃষক হোসেন আলী ও নাটশাল গ্রামের কৃষক তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করতে শুকানো, ফ্যানিং করা, ব্যাংক একাউন্ট খোলা, ময়েশ্চারসহ নানা রকম ঝামেলা পোহাতে হয়। ধান দেয়ার পরও টাকা উঠাতে গিয়ে ধাপে ধাপে বিড়ম্বনা। খোলা বাজারে ঝামেলা ছাড়াই বিক্রি করা যায়।’
ধান ব্যবসায়ী জামান হোসেন জানান, বর্তমানে বাজারে ধান নেই বললেই চলে। বাজারে যেটুকু ধান বেচাকেনা হচ্ছে বড় বড় মজুদদারের ধান। জেলার মহাদেবপুর, স্বরসতীপুর ও মাতাজি হাটে গত ১ মাস থেকে স্বর্ণা ৫ বিক্রি হচ্ছে ১২০০ টাকা মণ। এছাড়া জিরাশাইল ১ হাজার ৩৫০ টাকা ও চিনিগুড়া ১ হাজার ৫৩০ টাকা মণ।
মহাদেবপুর উপজেলার চকগোবিন্দ এলাকার মিতু চালকলের মালিক শাহিনুর রহমান বলেন, ‘রোপা-আমন মৌসুমে ৫১ দশমিক ৬১০ মেট্রিক টন বরাদ্দ পেয়েছিলাম। সেখানে প্রতি কেজিতে তিন টাকা করে লোকসান দিয়ে ২৫ দশমিক ৮১১ মেট্রিক টন চাল গুদামে দিয়েছি। খোলা বাজারে সুমন স্বর্ণা চালের দাম ছিল ৪০ টাকা কেজি। অথচ গুদামে দিতে হয়েছে ৩৭ টাকা কেজি। যেহেতু সরকারের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল তাই বাধ্য হয়ে চাল দিয়েছি। এতে প্রায় ৭৭ হাজার টাকার মতো লোকসান হয়েছে।’
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘খোলা বাজারে ধান-চালের দাম বেশি থাকায় অনেক মিল মালিক চুক্তিবদ্ধ হননি। আবার অনেকে লোকসান করে গুদামে চাল দিয়েছে।’তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু রোপা-আমন মৌসুমে সিংহভাগ মিলার সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়নি। আগামীতে যদি সরকার অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে আবারও চাল সংগ্রহ করতে চায় তাহলে নতুন করে সবার সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। যারা এবার গুদামে চাল দিয়েছে শুধু তাদের কাছ থেকে চাল নেয়া হলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। এছাড়া সরকার চাল আমদানি করায় বর্তমান বাজার স্থিতিশীল রয়েছে। যা সব মহলের জন্য খুবই ভালো হয়েছে।’
নওগাঁ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আশরাফুজাম্মান বলেন, ‘দুটি কারণে ধান ও চাল সংগ্রহ করা হয়। একটি হচ্ছে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য প্রদান এবং অপরটি নিরাপত্তা মজুত গড়ে তোলা। সরকারি যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল তার থেকে খোলা বাজারে ধান-চালের দাম বেশি ছিল। এ কারণে এবার আমন মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বিদেশ থেকে সরকারি-বেসরকারিভাবে চাল আমদানি শুরু করা হয়েছে। আমরা আশা করছি অনতিবিলম্বে আমাদের নিরাপত্তা মজুত গড়ে উঠবে।’#
