
মহাদেবপুর দর্পণ, কিউ, এম, সাঈদ টিটো, নওগাঁ, ৯ এপ্রিল ২০২১ :
সৃষ্টি আর ধ্বংসে এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ সৃষ্টিতে আবার কেউ ধ্বংসের খেলায় মত্ত। আবার কারোর দায়িত্বহীনতায় কালের গহ্বরে সমাহিত হচ্ছে ঐতিহাসিক অতীত। বর্তমান যেমন গুরুত্ববহ, সোনালী অতীতও তেমনি অনুপ্রেরণা যোগায়। আমরা বাঙালী, আমাদের রয়েছে ঐতিহাসিক অতীত। বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাসের স্মৃতি চিহ্ন। এসব ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজরিত স্থানসমূহ আমাদের স্বত্তাতে আলোড়ন জাগায়।
তেমনি আলোড়ন জাগানো ঐতিহাসিক স্থান নওগাঁর দুবলহাটি রাজবাড়ী। এ রাজবাড়িটি নওগাঁ শহর হতে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অযত্নে ও অবহেলায় দুইশ বছরের পুরনো এ রাজবাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, ১৭৯৩ সালে রাজা কৃষ্ণনাথ লর্ড কর্ণওয়ালিস এর কাছ থেকে ১৪ লাখ ৪ শ ৯৫ টাকা দিয়ে পত্তন নিয়ে এ রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। রাজা কৃষ্ণনাথ নি:সন্তান হওয়ায় তার পরবর্তীতে ১৮৫৩ সালে রাজত্বভার গ্রহণ করেন তার নাতি রাজা হরনাথ রায়। রাজা হরনাথের আমলে দুবলহাটির রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তিনি দুবলহাটি রাজ প্রাসাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, নাট্যশালা নির্মাণ ও প্রজা সাধারণের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট দূরীকরণের জন্য রাজ প্রাসাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক পুকুর খনন করেন। ১৮৬৪ সালে রাজ পরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্কুলটির রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়।

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার পর রাজা হরনাথ রায় ভারতে চলে যান। কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে যায় সুবিশাল অট্টালিকা। রাজবাড়ির মূল ফটকে রোমান স্টাইলের স্তম্বগুলো রাজাদের রুচির পরিচয় বহণ করে। রাজবাড়িতে সবমিলিয়ে ৭টি আঙিনা এবং প্রায় ৩শ’ ঘর ছিল। প্রাসাদের ভেতরে ভবনগুলো কোনটি তিনতলা কোনটি চারতলা ছিল।
প্রাসাদে ছিল রাজরাজেশ্বরী মন্দির যেখানে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হতো প্রতি সন্ধ্যায়। শোনা যেতো শঙ্খের ধ্বনি যা কালের বির্বতনে আজ জন মানবহীন শশ্মানে পরিণত হয়েছে। রাজবাড়িতে এখনো সান বাধানো একটি কুয়ার অস্তিত্ব রয়েছে। রাজবাড়ির সামনে গোবিন্দ পুকুর। যার পাশে ছিল এলাকায় প্রচলিত “গান বাড়ি” নামক ভবন যেখানে গান বাজনাসহ বিভিন্ন মনোরঞ্জনের কাজ চলতো। নওগাঁর এমপি আব্দুল জলিল কর্তৃক এ ভবনের উন্নয়ন সাধন করে এটিকে হাসপাতাল তৈরীর চেষ্টা করা হলেও এ কার্যক্রম পরিণতি পায়নি শেষ পর্যন্ত।
গান বাড়ি’র অনতিদূরে ছিল কালী মন্দির। যেটি এখন আগাছায় পরিপূর্ণ। কালী মন্দির হতে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে বয়েছে রাজার “বাগানবাড়ি”। বাগানবাড়িতে এখন দুটি পরিবার বসতি স্থাপন করেছেন। এক সময় অনেক জৌলুস ছিলো তৎকালীন রাজাদের তা বর্তমানেও রাজবাড়ির ধংসাবশেষ দেখে বোঝা যায় অনায়াসে। রাজ্যের বিস্তারে এলাকায় ব্যাপক প্রভাব ছিলো এ রাজ পরিবারের। হরনাথ রায় চৌধুরী রাজা খেতাব পেয়েছিলেন। এর আগের পূর্ব পুরুষরা মোগলদের দেয়া জমিদার খেতাবে ভূষিত ছিলেন। রাজ পরিবারের গিণেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে অন্তর্ভূক্ত ২২ কাহন কৈ মাছ দিয়ে রাজস্ব প্রদানের স্বীকৃতি রয়েছে।
বর্তমানে রাজবাড়ির গেটের পাশে ছিন্নমূল বাবুর পরিবারের আবাস। রাজবাড়ির দুতলায় তিন-চার বছর ধরে দখল করে কবুতর পালন করছেন স্থানীয় যুবক আলম। জমিদারির বিলুপ্তির পর সরকার রাজবাড়িকে সরকারি সম্পদ হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নেয়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও অদ্যাবধি এর সুরক্ষা বা সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের কবলে পরে দিনে দিনে রাজবাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুট হয়ে যায়। মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এখন দালানের ইট খুলে নিয়ে এলাকায় অনেকেরই বাড়ি তৈরী হবার কথাও প্রচলিত রয়েছে।
অবহেলা অযত্নে ধ্বংসের দারপ্রন্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুবলহাটি রাজবাড়িতে এখন সকাল-সন্ধ্যা সব সময়ই চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। অবাধে বসছে মদ, জুয়া, গাঁজার আড্ডা। এ রাজবাড়ী হয়ে উঠেছে উন্মুক্ত অসামাজিক কার্য কলাপের কেন্দ্র বিন্দু। কেউ দেখার নেই। কারোর মাথা ব্যাথা নেই।
এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে এই রাজবাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।
স্থানীয়রা এই ঐতিহাসিক নিদর্শন, বাংলার গৌরবোজ্জল ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহাসিক দুবলহাটি রাজবাড়ি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন।#
