
মহাদেবপুর দর্পণ, বাবুল আকতার, স্টাফ রিপোর্টার, সাপাহার (নওগাঁ), ৫ মার্চ ২০২১ :
নওগাঁ জেলার সীমান্তবর্তী সাপাহার উপজেলা ইতোমধ্যে কৃষিপণ্য নির্ভরশীল এলাকা হিসেবে সারা দেশে সুনাম অর্জন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় অন্যের জমি লীজ নিয়ে মিশ্র ফল বাগান তৈরী করে উপজেলার ফুটকইল গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা কৃষক সাখাওয়াত হাবিব এখন কোটিপতি। একই সাথে তার আম ও বরই বাগানে দিন মজুরীর কাজ করে খেয়ে পরে সুখে দিন কাটাচ্ছেন এলাকার শতাধিক পরিবার।
তার আম গাছের সারির ফাঁকে ফাঁকে চার ফুট উচ্চতার একেকটি গাছ। ডালে থোকায় থোকায় ধরে আছে বরই। পরিপক্ব বরইগুলো দেখতে অনেকটা লাল ও সবুজাভ আপেলের মতো। ৯৬ বিঘার বিশাল এই বাগানে এবারই প্রথম বরই ধরেছে। এক সপ্তাহ ধরে বরই বিক্রি করছেন কৃষক সাখাওয়াত। প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ মণ বরই নামছে তার বাগান থেকে। এবার বরই বিক্রি করে তিনি কোটি টাকা আয় করবেন বলে আশা করেছেন।
গত বছর আমের মৌসুমে মিশ্র ফলের এই বাগান থেকে ২৫ লাখ টাকার আম বিক্রি করে ছিলেন সাখাওয়াত। মিশ্র ফল বাগান করে সাখাওয়াত এলাকার অন্যান্য কৃষকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। তার এই বাগান দেখে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন বহু লোক আসেন। অনেকে তাঁর কাছ থেকে মিশ্র ফল বাগান তৈরির পরামর্শ গ্রহণ করেন।
তার বিশাল এই মিশ্র ফল বাগানটি উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরে শিরন্টি ইউনিয়নের ফুটকইল গ্রামের পাশে অবস্থিত। ৯৬ বিঘা জমি জুড়ে দুই বছর আগে গড়ে তোলা এই বাগানে আম্রপালি, আশ্বিনা, বারিফোর ও গৌড়মতি জাতের আম গাছ রয়েছে। আম্রপালি জাতের আমগাছই বেশি। আম গাছের সারির ফাঁকা জায়গায় লাগিয়েছেন বল সুন্দরী, কাশ্মেরী আপেল, বেবি কুল, সেডলেস ও থাইকুল জাতের বরই গাছ। ১১ হাজার ৭০০টি বরই গাছের মধ্যে বল সুন্দরী জাতের বরই গাছই বেশি।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাঁচ থেকে ছয় ফুট উচ্চতার আমের গাছের সারির মাঝে চার থেকে সাড়ে চার ফুট উচ্চতার একেকটি বরই গাছ। এসব গাছের ডালে থোকায় থোকায় ধরে আছে বরই। আমের গাছগুলোতে মুকুল এসেছে। বিশাল সেই বাগানে ১০-১২ জন করে শ্রমিক বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গাছ থেকে পাকা বরই ছিঁড়ছেন। বাগান থেকে সদ্য তোলা বরই কিনতে রাজশাহী ও পাবনা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসছেন।
সাখাওয়াত হাবিব জানান, তিনি বছরে প্রতি বিঘা জমি ৩০ হাজার টাকা চুক্তিতে ২০১৮ সালে ফুটকইল গ্রামের ওই মাঠে ৯৬ বিঘা জমি ১২ বছরের জন্য লীজ নেন। ওই বছরেই ইজারা নেওয়া জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ১২ হাজার ৮০০টি আমের গাছ লাগান। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সেই বাগান পরিদর্শনে এসে সাপাহার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আম গাছের সারির ফাঁকা জায়গায় উন্নত বরই গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। তাঁর পরামর্শ মতো তিনি চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বরই গাছের চারা সংগ্রহ করেন এবং আম গাছের সারির ফাঁকে ফাঁকে ১ ফুট লম্বা সমপরিমাণ ১১ হাজার ৭০০টি বরই গাছের চারা রোপন করেন। গত বছরের মে মাসে তিনি এসব চারা রোপন করেন। ৯৬ বিঘা জমিতে বরই চাষ করতে তাঁর ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৭ লাখ টাকার বরই বিক্রি করেছেন তিনি। আরও অন্তত ৯০ লাখ টাকা পাবেন বলে আশা করছেন।
তিনি জানান, ২০০৭ সালে তাঁর নিজের একটি মোটরসাইকেল ও মায়ের দেওয়া একটি গাভী বিক্রি করে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় পত্নীতলায় নির্মইল এলাকায় এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১২ বিঘার একটি আমের বাগান তিন বছরের জন্য লীজ নেন। ওই বাগান পরিচর্যা করে পরের বছরই সেই বাগানের আম বিক্রি করে তিনি ৪ লাখ টাকা আয় করেন। লাভের সেই টাকা দিয়ে ১২ হাজার টাকা বিঘা চুক্তিতে ১২ বছরের জন্য নির্মইল এলাকায় আরও ২০ বিঘা জমি ইজারা নেন। সেখানে গড়ে তোলেন আমের বাগান। এরপর প্রতি বছর তাঁর পুঁজি বাড়তে থাকে। সাপাহার উপজেলার ফুটকইল এলাকার ৯৬ বিঘার ওই মিশ্র ফল বাগান ছাড়াও সাপাহার ও পার্শ্ববর্তি পত্নীতলা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে তাঁর ৩৫০ বিঘার আম বাগান রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বরেন্দ্র এলাকায় উৎপাদিত বরই বেশি সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদা অনেক। তাই বেশী চাষ হচ্ছে। আম লাভজনক হলেও চারা লাগানোর দুই বছর পর ফল ধরে। মিশ্র ফল বরই অল্প সময়ে পাওয়া যায়। অধিক লাভের আশায় বরই চাষে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়ি। এ বছর প্রতিমণ বরই পাইকারি দুই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসেব অনুযায়ী এক কোটি টাকার ফল বিক্রি হবে বলে।’
সাখাওয়াত হাবিব এর সাফল্যে ইতোমধ্যেই এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এলাকার অনেক যুবক বরই চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
অন্যান্য ফসলের তুলনায় মিশ্র চাষ অধিক লাভজনক। মিশ্র বাগানে তেমন কোনো পরিচর্যা করতে হয় না। প্রথমে গাছ লাগানো এবং জমি তৈরির পর কীটনাশ ও যৎসামান্য পরিচর্যা ছাড়া কঠিন কোনো পরিচর্যা করতে হয় না।
শিক্ষক আতিকুর রহমান বলেন, ‘আমি বদলগাছি উপজেলা থেকে বাগানটি দেখতে এসেছি। অনেকের মুখ থেকে শুনেছি সাখাওয়াত হাবিব এর বাগানের কথা। এখানে এসে অনুপ্রেরণা পেলাম এবং অন্যেকে তার সফলতার গল্প বলবো বাগানটি সম্পর্কে। বাগানটি সকলকে একবার এসে দেখে যাওয়া উচিৎ অনুপ্রেরণা পাবার জন্য। আমি নিজেও একটি বাগান করবো সিদ্ধান্ত নিয়েছি দেখার পর। খুব সুন্দর পরিবেশ এখান থেকে প্রত্যেকের শিক্ষা নেয়া উচিৎ একজন বেকার যুবক কৃষি কাজ করে কোটিপতি হতে পারে তার জলন্ত উদাহরণ। সব চাইতে বড় কথা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এতো সুন্দর একটি বাগান। চমৎকার দৃশ্য যা কল্পনাও করা যায় না।’
কর্মরত কৃষি শ্রমিরা জানান, এখানে জমির বেড তৈরি, পানি সেচ, আম ভাঙ্গা, বরই ভাঙ্গাসহ সব ধরনের কাজ বছর জুড়ে তারা করে থাকেন। প্রতিদিন পারিশ্রমিক পান ৪০০ টাকা।
ফল বিক্রেতা হারুন-অর রশীদ বলেন, ‘আমি মৌসুমি ফল ব্যবসায়ী। সাখাওয়াত হাবিব ভাই এর বাগান থেকে বরই ও আমসহ নানা ধরনের ফল কিনি। এতো বড় বাগান সাপাহার, পোরশার মধ্যে একটিই। এখান থেকে ফল কিনে বরিশাল, ঢাকা, চট্রগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বিক্রি করি। বরই সিজনে প্রতিদিন ১৫০-২০০ ক্যারেট ক্রয় করি। এই সিজনে বরই প্রতিমণ ২০০০ থেকে ২৪০০ টাকায় কিনছি। তিনি অন্য কারো কাছে ফল বিক্রি করেন না। তাই লাভের অংশটা বেশি থাকে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মজিবুর রহমান বলেন, ‘সাখাওয়াত হাবিব যেন আরও বেশি লাভবান হতে পারেন এজন্য আমি তাঁর আম বাগানের ফাঁকা জায়গা ফেলে না রেখে সেখানে বরই চাষ করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এখন তিনি তার উপকারিতা পাচ্ছেন। তাঁর দেখাদেখি অন্যান্য কৃষকেরাও অনুপ্রাণিত হচ্ছেন। বহু কৃষক সাখাওয়াতের মতো মিশ্র ফল বাগান গড়ে তোলার জন্য আমাদের কাছে পরামর্শ নিতে আসছেন। আমের পাশাপাশি প্রতি বছরই উপজেলায় বরই চাষ বাড়ছে। বর্তমানে উপজেলায় ৪০ হেক্টর জমি জুড়ে বরই চাষ হচ্ছে।#