নওগাঁ ০৯:২৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
পরীক্ষামূলক সম্প্রচার :
মহাদেবপুর দর্পণ.কম ও সাপ্তাহিক মহাদেবপুর দর্পণের পরীক্সষমূলক সম্প্রচারে আপনাকে স্বাগতম ## আপামর মেহনতি মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসায় সিক্ত নওগাঁর নিজস্ব পত্রিকা ## নওগাঁর ১১ উপজেলার সব খবর সবার আগে ## মহাদেবপুর দর্পণ একবার পড়ুন, ভালো না লাগলে আর পড়বেন না ## যেখানে অনিয়ম সেখানেই মহাদেবপুর দর্পণ ## যেখানে দূর্নীতি, অন্যায়, অবিচার সেখানেই মহাদেবপুর দর্পণ সব সময় সাধারণ মানুষের পাশে ## মহাদেবপুর দর্পণের ফেসবুক আইডিতে ফলো দিয়ে সঙ্গেই থাকি ##

সম্পাদকীয় : সাংবাদিকবান্ধব নাসির ভাই<<মহাদেবপুর দর্পণ>>

মহাদেবপুর দর্পণ, ২৬ জানুয়ারী ২০২১ :

রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক প্রাপ্ত উত্তরগ্রাম ইউপির সাবেক জনপ্রিয় চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির ভাইয়ের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। সাংবাদিকবান্ধব এই চেয়ারম্যান কিভাবে সাংবাদিকদের সহযোগিতা করেছিলেন তার একটি ঘটনা আমি লিখেছিলাম অনেক দিন আগে। তার শ্রদ্ধায় লেখাটি পূণ পত্রস্থ করা হলো :

বন্ধু আমার

কিউ,এম,সাঈদ টিটো, মহাদেবপুর (নওগাঁ), ৯ মে ২০১৮ :

এ ফ্রেন্ড ইন নিড, এ ফ্রেন্ড ইন ডিড। অথবা, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। অথবা, সুসময়ে সকলেই বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয়। এরকম আরো অনেক প্রবাদ আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, বন্ধুর প্রকৃত সঙ্গা বের করতে পারলে এসব প্রবাদ অচল। কারণ, বন্ধু মানে যে উপকার করে। আর উপকারের বদলে যে ক্ষতি করে, সে তো কখনোই বন্ধু হতে পারেনা। সে হলো শত্রু। আসলে মানুষের জীবনে এমন অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব হয়, যারা এক সময় না এক সময় উপকার করার বদলে ক্ষতি করে থাকে। একদা এক সময় সে বন্ধু থাকলেও জীবনের চরম কোন মূহুর্তে শত্রুতে পরিণত হয়। গুরুজনেরা উপদেশ দিতে পারেন, শাসন করতে পারেন, সহধর্মীনি অভিমান করতে পারে, বাট একজন বন্ধু শুধুমাত্র উপকারই করতে পারে, অন্য কিছু নয়।

আমার জীবনে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। প্রকৃত বন্ধু বলতে যা বোঝায় তার সব কিছুই ছিল, বন্ধু আমার রাজ্জাকের মধ্যে। আমার অনেক জুনিয়র হলেও সে আমার বন্ধুই ছিল। শত্রুতা হতে পারে এমন কোন কাজে সে হাত দেয়নি কখনো। আমিও না। আসলে রাজ্জাক আমার শুধু বন্ধুই নয়, সে ছিল আমার সমমনা, সহকর্মী, সহযোদ্ধা। ছিল একাধারে সাংবাদিক, সংগঠক, লেখক আর একটা দারুন সাদা মনের মানুষ। আমিই ওকে এসব বানিয়েছিলাম। সে তার প্রতিদানও দিয়েছে, আমার মত থেকে।

এক সময় টিটো, রাজ্জাক, মুনসুর ছিল মহাদেবপুরের মানিক ত্রয়ী। মানুষের উপকারে আসে এমন নতুন নতুন কাজ করাই ছিল এই ত্রয়ীর ব্রত। পরে অবশ্য অনেকেই যুক্ত হয় ত্রয়ীর সাথে। অনেকের কথা আজ বলবোনা। আজ মনে পড়ছে রাজ্জাককে নিয়ে নানান কথা। একেকটা কাহিনী অনেক বড়, চমকপ্রদ, অবিশ্বাস্য আর রোমাঞ্চকর।

সাহসী সাংবাদিক রাজ্জাক : আই সেল্যুট ইউ ফ্রেন্ড

বন্ধু আমার মো: আব্দুর রাজ্জাক, পিতা মৃত শফিউদ্দিন মন্ডল, মদিনা মার্কেট, মহাদেবপুর বাজার, মহাদেবপুর, নওগাঁ। বর্তমানে উপজেলা পশুপালন কর্মকর্তা, রাজশাহী বিমান বন্দর, নওহাটা, রাজশাহী।

১৯৮৮ সালের কথা। আমি তখন রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দেশের একমাত্র সরকারী পত্রিকা দৈনিক বার্তা আর বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক করতোয়ার মহাদেবপুর উপজেলাস্থ নিজস্ব সংবাদদাতা। এছাড়া রেডিও বাংলাদেশ রাজশাহী কেন্দ্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার। সকালের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার লেখা নওগাঁ জেলা সমাচার প্রচার হতো। ৫ মিনিট ব্যাপ্তি। পরবতী ৪ বছরে ৪৮টি প্রোগ্রাম ব্রডকাষ্ট হয়েছে। এজন্য আমাকে সম্মানী দেয়া হতো ৫০ টাকা। দ্বিতীয় বছরে তা উন্নীত হয় ৬৭ টাকায়। রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ি। থাকি হোষ্টেলে। বাট দিনের বেশীরভাগ সময় কাটে দৈনিক বার্তা আর ইউনিভারসিটিতে সাংবাদিকতা আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

আর রাজ্জাক বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক উত্তরবার্তার নিজস্ব সংবাদদাতা। তখন নিউজ পাঠানোর মাধ্যম ছিল ডাক হরকরা। চিঠির মাধ্যমে রাজ্জাক আমার ঠিকানায় নিউজগুলো পাঠাতো। সেগুলো আবার আমি রিরাইট করে পাঠাতাম আমার পত্রিকায়। সপ্তাহান্তে মহাদেবপুর আসতাম। তখন দু’একদিন বা তার বেশী অবস্থান করে পুরো সপ্তাহের বাকী নিউজ সংগ্রহ করে নিয়ে যেতাম।

এরই ধারাবাহিকতায় একবার রাজশাহী থেকে মহাদেবপুর এসে শুনলাম, মহাদেবপুর সমাজ কল্যাণ (এখন সমাজ সেবা) অফিসের এক ফিল্ড ওয়ার্কার, নাম স্বপন বাবু। দীর্ঘদিন ধরে মহাদেবপুরে চাকরি করে আসছে। তার অদৃশ্য খুটির জোরে তাকে কেউ অন্যত্র ট্রান্সফার করতে পারেনা। উপজেলার আখেড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু লোকের বাসায় থাকতো স্বপন বাবু লজিং। কথিত আছে যে, গৃহকর্ত্রীর সাথে তার অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরই জের ধরে গৃহস্বামী আবার তার বয়লারের এক চাতাল কন্যার সাথে অনুরুপ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। গৃহকর্ত্রী তার স্বামীকে সায়েস্তা করতে বয়লারের ঐ মহিলাকে নাজেহাল করার জন্য স্বপন বাবুকে নিয়োগ করেন।

চারদিন আগে রাতে একদল দুর্বৃত্ত ওই মহিলাকে অপহরণ করে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে উপর্যুপরী ধর্ষণ করে। পরে তার গোপনাঙ্গে গরু বাঁধার খুটা প্রবেশ করিয়ে তাকে মারাত্মক জখম করে। সকালে স্থানীয়রা অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে মহাদেবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করিয়ে দেয়। তারা মহাদেবপুর থানা পুলিশকেও বিষয়টি জানায়। কিন্তু চার দিনেও দূর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোনই ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় গ্রামের লোকেরা একটি ট্রাকে চেপে শ্লোগান দিতে দিতে উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়ী ধনজইল গ্রামে যায়। সেখানে তারা তদানিন্তন উপজেলা চেয়ারম্যান শ্রী ফটিক চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে লাটু বাবুর কাছে একটি স্মারক লিপি পেশ করে।

বিষয়টি জানার পর পরই কিভাবে নিউজ করবো তা নিয়ে আমি আর রাজ্জাক পরামর্শ করে নিই। রাতেই আমার শ্বাশুড়ী খন্দকার হাফেজান বেওয়াকে ম্যানেজ করে তার বড় ন্যাশনাল টেপ রেকর্ডারটি নিয়ে রাখি। সকালে ৬টি বড় ব্যাটারী কিনে টেপ রেকর্ডারটি চালু করি। কিনি নতুন একটি ক্যাসেট। সঙ্গে নিই প্রিয় ইয়াশিকা ফিক্সড ফোকাস ক্যামেরা। এবার চেপে বসি আমার বাইসাইকেলে। মাথায় ক্যাপ আর চোখে চশমা, রোদ থেকে বাঁচার জন্য। ঘারে ঝুলানো ক্যামেরা। সাইকেলের পিছনে কেরিয়ারে যথারীতি রাজ্জাক। কোলের উপর বড় টেপ রেকর্ডার।

প্রথমেই আমারা যাই মহাদেবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, যেখানে ভর্তি আছেন ভিকটিম। তার কাছে গিয়ে সব ঘটনা শুনি, দীঘসময় ধরে। হাসপাতলের বেডে তার ছবি তুলি। সাংবাদিক শুনে প্রথমে ভয় পেলেও আমরা স্থানীয়ভাবে বেশ পরিচিত জন্য জীবনের সব ঘটনা খোলা মেলা বলে ফেলেন সেই নির্যাতিত মহিলা। নির্যাতনের কাহিনী বলতে বলতে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। পুরো হাসপাতালের সবার কান সেদিকে। সকলের চোখই একসময় ভরে ওঠে কষ্টের কান্নায়।তিনি জানান, থানা পুলিশ হাসপাতালে এসে তার বক্তব্য নিয়ে গেছে।

তার কথা শুনে আমরা যাই তদানিন্তন উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসকের কাছে। তিনি জানান, মহিলাটি গ্যাং রেপের শিকার হয়েছেন। আর তার গোপনাঙ্গে খুটা প্রবেশ করানোয় প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। চিকিৎসা চলছে। তার অবস্থা এখনও আশংকাজনক। তাকে রাজশাহীতে রেফার্ড করা হয়েছে। কিন্তু তাকে সহায়তা করার মত কেউ নেই জন্য উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে অন্য কোথাও পাঠানো যায়নি।

সেখান থেকে আমরা গেলাম ঘটনাস্থলে। যে বয়লারে মহিলাটি কাজ করতেন সেখানে। তার সাথে যারা কাজ করতো তাদের সাথে কথা বলি। পুরো ঘটনা তাদের মুখে শুনে সত্যতা যাচাই করি।পাশেই ঐ প্রভাবশালী হিন্দু লোকের বাড়ী। তিনি শুধু তার এলাকায় নন, বরং পুরো মহাদেবপুরে এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। উপজেলা পরিষদের জায়গা তিনি দান করেছেন। তার দান করা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মডেল স্কুল। কয়েকটি বয়লারের মালিক তিনি। সেখানে গিয়ে তাকে বাড়ী থেকে ডেকে নিয়ে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। তিনি আমাদেরকে কোন কথাই বলতে রাজি হননি।

আমাদেরকে তিনি খুব ভাল করেই চিনতেন। আমরা যে সাংবাদিক তাও জানতেন। কথা নেয়ার জন্য আমরা যে, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, মহাদেবপুর থানা শাখার কর্মকর্তা তাও জানাই। কিন্তু তিনি বলেন ঠিক আছে, আমারও লোক আছে এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালে। তাদের সাথে কথা বলি। তারপর আমার দরকার হলে তোমাদের সাথে কথা বলবো। তার নয়, বরং আমাদের নিউজের প্রয়োজনেই তার সাথে কথা বলতে এসেছি জানিয়ে আমরা তার কাছে শুধু জানতে চাই যে, চারদিন আগে সংঘটিত বিয়টি তিনি জানেন কিনা। তিনি জবাব দেন, এটা ভূয়া রটনা। এধরনের কোন ঘটনাই সেখানে ঘটেনি। আমরা জানাই মহিলাটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ডাক্তার বলেছেন তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। জবাবে তিনি বলেন, ওটা ব্লিডিং না। তার মাসিক হয়েছে। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম মাসিক হবার বিষয়টি আপনার জানার কথা নয়। তিনি বললেন, তার সাথে কাজ করা মহিলাদের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন। আমরা বুঝে নিলাম এ কথার মাধ্যমেই তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, ঘটনা একটা ঘটেছে এবং তিনি তা জানেনও। কিন্তু বিষয়টি আমরা তাকে বুঝতে দিলাম না।

অভিযুক্ত সমাজ কল্যাণ অফিসের ফিল্ড ওয়ার্কার এখন কোথায় জানতে চাইলে তিনি জানান, ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক। আসার সময় আমরা তাকে সাজেশন দিলাম নির্যাতিত মহিলাটির ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করা তারই উচিৎ। যে মাঠকর্মী তার বাড়ীতে থাকতো, তার নেতৃত্রেই দূর্বৃত্তরা ওই মহিলার উপর নির্যাতন চালায় বলে মহিলাটির অভিযোগ। নির্যাতিত মহিলার সাথে আপনার গোপন সম্পর্ক ছিল বলেও এলাকাবাসী বলছে। একথা শুনে তিনি আমাদের উপর রেগে যান। তিনি বলেন, তোমরা আমাকে হুমকি দিচ্ছ? দাঁড়াও তোমাদের বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। বলেই তিনি বাড়ীর ভিতর চলে যান।

এবার সত্যিই আমরা ভয় পাই। না জানি, বাড়ীর ভিতর থেকে লাঠি সোঠা নিয়ে লোকজন এসে আমাদের উপর চড়াও হয়। ভয়ে ভয়ে রাজ্জাকের দিকে তাকাতেই সে ইশারা করলো, চল পালাই। যে কথা, সেই কাজ। মূহুর্তে সচল হলো সাইকেল। আসার সময় সভাবসূলভভাবে রাজ্জাক ঝগড়া শুরু করলো, তোক আগেই বলেছি বেশী কথা বলার দরকার নাই। ওরা ধাবাড় দিলে সামলাতে পারতু ? আমি সাবমিশন রাখলাম, প্রধান অভিযুক্তই তিনি। তার বক্তব্য ছাড়া নিউজ হবে? যত কঠিনই হোক সে কাজ করতে পারাটাইতো সাংবাদিকের কাজ। রিস্ক না নিলে সাংবাদিক হতে পারবি ?

দু’জনে ঝগড়া করতে করতে যথাসম্ভব দ্রুত পৌছে গেলাম উপজেলা সমাজ কল্যাণ অফিসে। অফিসার স্বীকার করলেন, তার কর্মচারীটি ৪দিন ধরে আন অথারাইজ এ্যাপসেন্ট। তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি জানান, এখনও নেয়া হয়নি। তবে আজই তিনি সোকস করবেন।

এখান থেকে আমরা গেলাম উপজেলা চেয়ারম্যানের সরকারী চেম্বারে।উপজেলা চেয়ারম্যান লাটু বাবু স্বীকার করলেন ঘটনা। বললেন, তিনি বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্মারকলিপিটি মহাদেবপুর থানার ওসি বরাবর ফরোয়ার্ড করেছেন।ইতিমধ্যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাড়ীতে এসে টেপ রেকর্ডারটি চালাই। পরীক্ষা করে দেখি পরিকল্পনা মত রাজ্জাক ঠিক সময়মত টেপ রেকর্ডার টিপেছে। সব কথাই রেকর্ড হয়েছে ঠিক ঠিক। ওকে বলি এবার বাকী শুধু থানা পুলিশের বক্তব্য নেয়া। তাহলেই লিখতে পারবো বিশাল নিউজ।দুজনে নিজ নিজ বাড়ীতে গিয়ে গোসল সেরে ভাত খেয়ে আবার বের হই।

তখন একেবারে সন্ধ্যা। মাগরিবের নামাজের পর পরই গিয়ে ঢুকি মহাদেবপুর থানায় ওসির চেম্বারে।থানার অফিসাররা সব্বাই আমাদের দুজনকে চিনতো। ওসির চেম্বারে তখন মোট ৪ জন অফিসার। আমাদেরকে বসতে বললেন। বসলাম। রাজ্জাক বসে টেপ রেকর্ডারটি রাখলো টেবিলের উপর। কথা বলতে শুরু করলে ঠিক টিপে দিয়েছিল রেকর্ড বাটনটি। সারাদিন এই কাজটি আমি খেয়াল করিনি, কিন্তু এখানে কেন জানি আড় চোখে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম বিষয়টি। সারা শরীর তখন শিরশির করছিল। কারণ মনে হয়, নতুন কোন এ্যাডভেঞ্চার। আমি বললাম, খুব বেশী কিছু দরকার নাই। অল্প কয়েকটা তথ্য হলেই চলবে।

ওসি বললেন, বলেন কি জানতে চান। আমি বললাম, ৪ দিন আগে আখেড়াতে একটি মহিলা রেপ হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বিষয়টি আপনাদের নলেজে আছে কিনা ? ওসি প্রথমটায় একটু থতমত খেলেন। অন্য অফিসারদের দিকে তাকালেন। বেশ কিছুক্ষণ পর ওসি উল্টো প্রশ্ন করলেন, সেটার কি জানতে চান ? আমি বেশ সাবলিল ভাষায় বললাম, ঘটনাটা আপনারা জানেন কিনা ? সেকেন্ড অফিসার বললেন, শুনেছি। তবে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। আমার দ্বিতীয় এবং শেষ প্রশ্ন, আপনারা হাসপাতালে গিয়ে ভিকটিমের বক্তব্য নিয়েছেন কিনা ? এবার ওসি একেবারে ঘাবড়ে গেলেন। আবার কিছুক্ষণ দেরী। আবার তাকালেন অন্য অফিসারদের দিকে। আবার সেই সেকেন্ড অফিসার বললেন, হ্যাঁ। তার সাথে কথা বলেছি। তবে তা আন অফিসিয়ালী। আমি সন্তুষ্ট হয়ে বললাম, ঠিক আছে। আমার আর কোন প্রশ্ন নেই। থ্যাংক ইউ। চল রাজ্জাক।

আমি চলে আসতে চাইলাম ঠিকই। কিন্তু মনে হচ্ছিল আসতে পারছিলাম না। পুরো চেম্বার জুড়ে একটা থমথমে ভাব। মন বেশ উৎফুল্ল। মনে হচ্ছিল বিশাল কোন অসাধ্য সাধন করে ফেলেছি। কিন্তু ঘরের অন্য সবাই যেন অস্বস্তিতে। পিন পতন নিস্তব্ধতা। ঠিক এই সময় রাজ্জাক রেকর্ড করা বন্ধ করার জন্য আবার সেই বাটনে টিপ দিল। শব্দ হলো খটাশ করে। বাটনটি শব্দ করে উঠে গেল। রাজ্জাক আর আমি এক সাথেই উঠে দাঁড়ালাম ফিরে আসার জন্য। দরজার কাছে চলে আসলাম। ঠিক এই সময়ই টনক নড়লো পুলিশের। ওসি বললেন, একটু দাঁড়ান। বসেন চা খেয়ে যান।

থমকে দাঁড়ালাম আমরাও। কিন্তু ফিরতে চাইনা। ওসিও নাছোর বান্দা। বার বার বলে আমাদেরকে বসতে বাধ্য করালেন। চা এলো। কিন্তু আমাদের মন অন্যদিকে। এখান থেকে বেরুতে পারলেই নিউজ। সেকেন্ড অফিসার বললেন, দেখি কি রেকর্ড করলেন। আমি বললাম, আপনারা যা বলেছেন তাই রেকর্ড হয়েছে। এটা করার রাইট আমাদের আছে। এটা আমাদের পেশার সাথে সম্পৃক্ত। রিয়োন্ড বাটন চেপে আবার প্লে করে সবাই শুনলেন। এবার পুলিশেরা অন্যরকম আচরন শুরু করলো।

তারা সবাই আরও ভিতরে গোপন চেম্বারে গিয়ে পরামর্শ করতে লাগলেন। আশে পাশে কেউ নেই দেখে রাজ্জাকের দিকে তাকালাম। রাজ্জাক বললো, মনে হয় ভয় পাইছে। আমি বললাম, ঠিক। এই দুটা প্রশ্নেই ওরা বুঝে গেছে, ঘটনার ৪ দিন পরেও মামলা হয়নি। এ খবর ছাপা হলে ওদের চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে।ইতিমধ্যে সেকেন্ড অফিসার এসে আমাদের সার্চ করে ক্যামেরাটাও নিয়ে নিলেন। বাড়ীতে গিয়ে ভাগ্যিস আগের ক্যাসেটটা রেখে আবার একটা নতুন ক্যাসেট কিনে এনেছিলাম। না হলে আগের রেকর্ডগুলোও তাদের হাতে চলে যেত। মনে মনে নিজেদের গোয়েন্দাগীরির প্রশংসা করতে ইচ্ছে হলো।অফিসাররা দীর্ঘক্ষণ নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলেন। রেডিও রুমে গিয়ে পুলিশ সুপারের সাথে ওয়ারলেসে পরামর্শ করলেন।

ঘন্টাখানেক পর উত্তরগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান নাসির ভাই ওসির চেম্বারে আসলেন। আমাদেরকে দেখে কি ঘটনা শুনলেন। সব শুনে তিনি গোপন চেম্বারে গেলেন। আধাঘন্টা পর তিনি বেরিয়ে এসে আমাদেরকে বললেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ। তোমাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। শুনে আমি প্রকাশ্যে খুব ক্ষেপে গেলাম। হঠাৎ করেই রেগে যাওয়া ছিল আমার বদ অভ্যাস। বললাম, কি বলেন নাসির ভাই। আমরা কি চোর নাকি ? আমরা সাংবাদিক। যে কারও বক্তব্য রেকর্ড করার অধিকার আমাদের আছে। আমরা কি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ গোপণীয় কিছু রেকর্ড করেছি, যেটা ফাঁস হলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে ? এত বড় একটা ঘটনা, পুলিশ ৪ দিন ধরে ধামা চাপা দিয়ে রেখেছে, এটা কি আইন এ্যালাও করে ? নাসির ভাই বললেন, অনুমতি না নিয়ে বক্তব্য রেকর্ড করা অন্যায় হয়েছে। আমি বললাম, এত বড় টেপ রেকর্ডার, তার উপর রাজ্জাক তা রেখেছে একদম চোখের সামনে টেবিলের উপর। এটাতে রেকর্ড করা তারাও তো দেখেছে। এটা গোপণীয় হয় কিভাবে ? ঠিক আছে, না বলে বক্তব্য রেকর্ড করা অন্যায় কোন আইনে ? সে আইন দেখাক।

নাসির ভাই এবার একটু নরম হলেন। বুঝলেন আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে লাভ হবেনা। তিনি বললেন, টিটো ঝামেলা করে লাভ নাই। ওসি সাহেব বললেন যে তোমরা ভূল শিকার করে একটা চিরকুটে সই করে এখান থেকে বের হয়ে যাও। মামলা থেকে বাঁচো। আমি পরে তোমাদের সাথে দেখা করছি।মনে পড়লো নাসির ভাই আসলে নির্বাচিত ও জনপ্রিয় চেয়ারম্যান হলেও এখন থানার একজন মিডিয়া। এখানে এ পেশাটা খুব দাপটের। অনেক প্রভাবশালীই মিডিয়াগীরি করেছেন। আমি বললাম দেখি আমরা একটু পরামর্শ করি।নাসির ভাই বাইরে গেলেন।

আমি আর রাজ্জাক চুপচাপ আরও প্রায় একঘন্টা বসে থাকলাম। অধৈর্য হয়ে গেছি। ক্ষুধা লাগছে। বারে বারে নাসির ভাইয়ের হুমকির কথা মনে হচ্ছিল। মামলা হলে তো মুশকিল। দু’জনে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বুঝলাম দু’জনেই শারীরীক ও মানসিকভাবে ভীষণ ক্লান্ত। এখান থেকে যে কোন উপায়ে এখন বের হওয়া দরকার। মামলাকে আমি ভয় করিনা। কিন্তু রাজ্জাক নতুন ছেলে। তার বিরুদ্ধে মামলা হলে তার অভিভাবকেরা সব দায় চাপাবে আমার উপর। মনে মনে চাচ্ছিলাম, অন্তত রাজ্জাক বেরিয়ে যাক। আমার একার বিরুদ্ধে মামলা হোক। রাজ্জাক গিয়ে বাড়ীতে খবর দিতে পারবে। জামিন টামিন করাতে পারবে।

ডাকলাম, রাজ্জাক। রাজ্জাক কোন কথা না বলে বিরক্তি প্রকাশ করে ঠোট উল্টিয়ে ইঙ্গিতে জবাব দিল। আমি বললাম, লে না হয়, ভূল শিকার করে সই দিয়ে এখান থেকে পালায়ে বাঁচি। না হলে যদি মামলা দেয় তো জেল হাজাতে যাওয়া লাগবে। পুলিশের সাথে মামলা। জামিন হবেনা। রাজ্জাক মুখ কিষ্টা মিষ্টা করে মেজাজ গড়ম করে এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনলো। আমার কথা শেষ হতে না হতেই চেঁচিয়ে উঠলো, হারামজাদা, তুই সই দে। আমার বের হওয়া লাগবেনা। দেখি কয়টা মামলা দিতে পারে।

যাশ সর্বোনাশ। বলে কি ? ব্রেভো। মুখে কিছু বললাম না। কিন্তু মনে মনে অনেক কিছুই ভাবলাম। মনে হলো প্রকৃতপক্ষে রাজ্জাককেই থাকা লাগতো আমার জায়গায়। আর আমি রাজ্জাকের জায়গায়। আমি সাংবাদিকতা শুরু করি এই ঘটনার প্রায় ১০ বছর আগে ১৯৭৯ সালে। তখন আমি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করে জাহাঙ্গীরপুর কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হই। আমার খালু কাজী সাহের উদ্দিন আহমেদের মালিকানায় কাজী লাইব্রেরীতে পেপার বিলির চাকরি নিই। মানে হকারী করি। নওগাঁ জেলার প্রথম হকার আমি। তখন ঢাকা থেকে ইত্তেফাক ৬০ কপি আর রাজশাহী থেকে দৈনিক বার্তা ৪০ কপি আসতো ডাকযোগে। ইত্তেফাক ২ দিন পর আর দৈনিক বার্তা আসতো ১ দিন পর। দুপুরে কলেজ থেকে ফিরে সোজা পোষ্ট অফিসে গিয়ে পেপার নিয়ে এসে সাইকেলযোগে গ্রাহকদের বাড়ী পৌঁছে দেয়া ছিল আমার কাজ। বিনিময়ে ৩ বেলা খাবার আর মাসে ১০০ টাকা বেতন পেতাম। পেপার বিলি শেষে পেপার পড়া থেকেই সাংবাদিকতা, ছড়া লেখা আর সংগঠন করা শিখেছি আমি।

রাজ্জাক সাংবাদিকতায় আমার চেয়ে অনেক জুনিয়র। আমার কাছ থেকে শিখছে সে। কিন্তু তার সাহসীকতায় আমি মুগ্ধ। বিপদ জেনেও দারুণ কনফিডেন্স তার। নিজের প্রতি এই আস্থা, বিশ্বাস আর লোভে না পড়া কয়জন পারে ? থ্যাংকস। আই সেল্যুট ইউ ফ্রেন্ড।

অবশেষে নাসির চেয়ারম্যান আর সব পুলিশ অফিসার আবার এলেন আমাদের সামনে। এবার পুলিশ আমাদের জেরা শুরু করলো। কোন দল করেন ? আমি বললাম দৈনিক বার্তা সরকারী পেপার। রেডিও ও সরকারী। দু’জনের পুরো বায়োডাটা নিয়ে আইনের বইয়ের একটার পর একটা পাতা উল্টাতে লাগলেন ওসি।

নাসির ভাই বললেন, রাজ্জাক তোমরা কি ভূল স্বীকার করবে। আমরা দু’জনেই চুপ থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, আমরা কি ভূল করেছি সেটা বলেন। নাসির ভাই আবার বললেন, অনুমতি না নিয়ে কথা রেকর্ড করা। রাজ্জাক বললো, ঠিক আছে আমরা যদি ভূল করে থাকি, তাহলে ভূল স্বীকার করবো, ক্ষমাও চাইবো। কিন্তু সে আইনটা আপনি দেখান। যদি বক্তব্য রেকর্ড করার অধিকার না থাকে তাহলে তো সাংবাদিকতাই করা যাবেনা। ঠিক আছে, আইনে থাকলে সাংবাদিকতা করবোনা।

নাসির ভাই অধৈর্য হয়ে বললেন, আসলে তোমরা সমাধান চাচ্ছনা। আমার আর কিছু বলার নাই ওসি সাহেব। তবে নাসির ভাই শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে ছেড়ে দেবার সুপারিশ করেন। নাসির ভাই বেরিয়ে গেলে, সেকেন্ড অফিসার বললেন, আমরা আপনাদের ক্যামেরা আর টেপ রেকর্ডার সীজ করে রাখলাম। আপনারা এখন আসুন। রাজ্জাক বললো, আমাদেরকে সীজার লিষ্ট দেন। সেকেন্ড অফিসার একটা সাদা কাগজে সীজার লিষ্ট তৈরী করে আমাদেরকে সই করতে বললেন। রাজ্জাক বললো আরো এক কপি করে আমাদেরকে দেন। অগত্যা পুলিশ তাই করলো।

৮ঘন্টা থানায় আটক থাকার পর অবশেষে আমরা ছাড়া পেলাম রাত ২টায়।থানা থেকে বেরিয়ে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু অসন্তুষ্ট নই। যেন কোন ক্লান্তিই নেই আমাদের। বরং পুলিশের এই দূর্ব্যবহারের জবাব কিভাবে দিব, তাই ভাবছি কেবল। এখন বুঝছি, যারা অন্যায় করে ভয় তাদেরই থাকে। আর যারা কোনদিন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়না, তাদের শির থাকে সব সময় চীর উন্নত। অন্যায়কারী পুলিশই হোক আর বিশাল লাঠিয়াল বাহিনীর নেতা হোক সৎ লোকেরা তাদেরকে ভয় পাবে কেন ? আসলে সৎ থাকার যে একটা তৃপ্তি, স্বাদ, আনন্দ এটা এখনকার কোন সাংবাদিক পেয়েছেন কিনা আমার সন্দেহ আছে।

রাজ্জাক ওর বাড়ী গেলনা। গেল আমার সাথে আমার ভায়রা সিরাজ ভাইয়ের বাড়ীতে। সেখানেই একটি রুমে আমি আর আমার স্ত্রী শিউলী ভাড়া থাকতাম। জানালা দিয়ে ডাকলাম শীলুমনি, খোল। আমাদেরকে ভাত খেতে বললো। আমরা খেতে পারলাম না। সারাদিনের কোন ক্লান্তিই যেন নেই আমাদের। বাসা থেকে সাইকেলটি নিয়ে রাতেই আবার বেরিয়ে পড়লাম দু’জন।ডবল সাইকেল চালিয়ে ভোর ৬টায় পৌঁছে গেলাম নওগাঁ পৌরসভায়। সেখানকার নাইট গার্ডকে ডেকে সাইকেলটি অফিসে রাখতে বললাম। আমার দুলাভাই খন্দকার আব্দুল হাই তখন সে পৌরসভার সেক্রেটারী ছিলেন। বললাম দুলাভাইকে বলবেন, আপনার শালাবাবু সাইকেল রেখে ট্রেনযোগে রাজশাহী গেছে। ফিরে এসে সাইকেল নিবে।

দুলাভাই মারা গেছেন। বাট আমাকে অনেক অনেক ভালবাসতেন তিনি। তার কথা মনে হলে একজন সৎ মানুষের অবয়ব ভেঁসে উঠে চোখের সামনে।

এবার আমরা রিক্সাযোগে সান্তাহার রেলষ্টেশন। আর ভোর ৭টায় উত্তরা এক্সপ্রেসযোগে এক্কেবারে রাজশাহী পৌঁছলাম দুপুরে। আমার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের হোষ্টেলে গিয়ে ফ্রেস হয়ে সন্ধ্যায় গেলাম দৈনিক বার্তা অফিসে।

তখন নিউজ এডিটর ছিলেন ওয়াজেদ মাহমুদ। অত্যন্ত অধ্যবসায়ী, রিজার্ভ আর সাহসী সাংবাদিক ছিলেন তিনি। মফস্বলের সবাই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করতাম, ভয় করতাম। হাতে কলমে ক খ করে আমাদেরকে সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন তিনি। তার একদিনের কথা আমার খুব কানে বাজে। তিনি অনেকের সামনে খুব জোড়ে শব্দ করে বলেছিলেন, এই কি হয়েছে, টিটোকে আমি পছন্দ করে প্রতিনিধি বানিয়েছি। ১৯৮৫ সালে মহাদেবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান শ্রী বিশ্বেশ্বর দাস দাগু হত্যাকান্ডের পর দৈনিক বার্তার প্রথম পাতায় “তদন্ত রিপোর্ট : বিশ্বেশ্বর দাস কেন খুন হলেন” কিউ,এম,সাঈদ টিটো, শিরোণামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দৈনিক বার্তা অফিসে আমি গেলে আমাকে নিয়ে ডেস্কের সকলে হৈ চৈ করতে থাকলে এভাবে তিনি সকলকে থামান।

তখন সকলের কথা ছিল টিটো এত সাহস করলো কেন। খুনি কালু ডাকাত, ৯ ইউপি চেয়ারম্যান, টিএনও আর এত বাঘা বাঘা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে লিখেছে, তার লেখার পর পরই তারা এ্যারেষ্ট হয়েছে। ওরা জেল থেকে বেরুলে টিটোর উপর একশন নিবে তো। টিটোকে তখন কে সেভ করবে। দাগু বাবুর মত সেও তো মার্ডার হবে।

ওয়াজেদ ভাইয়ের একই কথা। সাংবাদিকদের এসব পরিণতির কথা ভাবলে কোন নিউজই লেখা যাবেনা। যেখানে যা ঘটছে সেটা নির্দিধায় লেখতে পারাটাই সাংবাদিকতা। সত্য ঘটনা লেখার পর কি ঘটতে পারে তা নিয়ে ভাবার দরকার নাই। সময়ই বলে দিবে কি করতে হবে। আই অলসো সেল্যুট হিম। সে সময় প্রতিদিন দাগু হত্যা মামলার আপডেট ছাপা হতো। খোদ রাজশাহীতে সে খবর সবাইকে জানাতে একটি গ্রুপ দেয়ালে পেপার সাটানো শুরু করে। লাল কালিতে দাগানো থাকতো দাগু হত্যা মামলার আপডেট নিউজ।

পরবর্তীতে ওয়াজেদ ভাই দৈনিক সোনালী সংবাদের প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। তখন দৈনিক সোনালী সংবাদের মহাদেবপুর প্রতিনিধি ছিল অসিত দাস। অফিসে ইফতার পার্টিতে অসিত আমাকেসহ রাজশাহী আসে। আমি আর অসিত সম্পাদক ওয়াজেদ ভাইয়ের চেম্বারে ঢুকি। এটা আমার সাথে তার দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ। আমাকে দেখেই তড়িঘড়ি চেয়ার থেকে ওঠে এসে ওয়াজেদ ভাই আমাকে বুকে টেনে নেন। যথাসাধ্য জোড় গলায় বলতে থাকেন, এই কে আছো, দেখো, দেখো আমার ভাই এসেছে।

মূহুর্তে আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। টুপ করে নীরবে গড়িয়ে পড়ে পানি। শ্রদ্ধার নতজানু হয় মাথা।ওয়াজেদ ভাইয়ের কাছে মহাদেবপুরের সব খুলে বলি। তিনি বলেন, নিউজটা লেখ। আমি নিউজ লিখি নিজস্ব সংবাদদাতা, মহাদেবপুর (নওগাঁ) ডেটলাইনে। নিউজ দেখে ওয়াজেদ ভাই বলেন, তোমার নিউজ তুমি লেখবা কিভাবে। আমি বললাম, ভাই আপনি তো আমাকেই লিখতে বললেন। ওয়াজেদ ভাই চীফ রিপোর্টার কাজল ভাইকে ডেকে বললেন নিউজটা তোমার নামে ব্যাক পেজে ছেড়ে দাও।

পরদিন সকালে দৈনিক বার্তার ব্যাক পেজে ষ্টাফ রিপোর্টারের ডেটলাইনে ছাপা হলো “মহাদেবপুর থানা পুলিশ সাংবাদিকদের ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডার কেড়ে নিয়েছে”। নিউজে মহিলাটির রেপসহ ডিটেইলস আছে।কয়েকটি পেপার কিনে নিয়ে সকালে আবার গেলাম দৈনিক বার্তায়। ওয়াজেদ ভাই একটি চিঠি লিখে দিলেন। বললেন, এই চিঠি নিয়ে গিয়ে দিবে নওগাঁ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ,কে,এম, মোরশেদকে। তিনি আমার বন্ধু মানুষ। তিনি যা বলেন, তাই করবে যাও। তিনি বললেন, রাজশাহীর ডিআইজি নিউজ দেখে তার সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন। ডিআইজি নওগাঁর পুলিশ সুপারকে বিষয়টি দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।

রাজশাহী থেকে আমি আর রাজ্জাক বাসযোগে গেলাম বগুড়া। রাতে দৈনিক করতোয় অফিসে গিয়ে সব খুলে বললাম সম্পাদক মোজাম্মেল হক লালু ভাইকে। নিউজ লিখে দিলাম। একটা দৈনিক বার্তা দিলাম।এরপর গেলাম রাজ্জাকের দৈনিক উত্তরবার্তা অফিসে। এর সম্পাদক মাহবুবুর রহমান ছিলেন আমার খুব প্রিয়, সৎ সাংবাদিক আর ভালো সংগঠক। একটি নিউজের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় তিনি জেলে গিয়েছিলেন। আমারা তার মুক্তির জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছি। তার কাছে রাজ্জাকের পক্ষে আমিই বিষয়টি খুলে বলি। তিনি নিউজ এডিটর সিদ্দিক ভাইকে ডেকে দৈনিক বার্তার নিউজ হুবহু ছাপতে বলেন।

এক্ষেত্রে উত্তরবার্তা আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। নিউজের শেষে টেলিফোনে নওগাঁর পুলিশ সুপারের বক্তব্য নিয়ে তা ছেপে দেয় এ পত্রিকাটি। পুলিশ সুপার বলেছিলেন, মহাদেবপুর থানার ওসি বলেছেন যে, তারা যে সাংবাদিক সেই পরিচয় দেয়নি। বরং তারা থানার সিকিউরিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে জানতে চেয়েছে কতজন ফোর্স আছে এখানে। তারা সর্বহারা দলের জঙ্গী হতে পারে বলে পুলিশের সন্দেহ এবং ইতিমধ্যেই তাদের বিরুদ্ধে থানা পুলিশ মামলা দায়ের করেছে বলেও জানান পুলিশ সুপার।

রাতে বগুড়াতেই থাকলাম। সকালে দৈনিক করতোয়া আর দৈনিক উত্তরবার্তা সংগ্রহ করলাম। উত্তরবার্তার কাভারেজ দেখে খুবই ভালো লাগলো। সম্পাদক নিজে এখানে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অথচ করতোয়া ? এর চরিত্র দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায়না। এই এত চাঞ্চল্যকর ঘটনার কোন নিউজই দেয়নি পত্রিকাটি। করতোয়া দেখে রাজ্জাক আবার রাস্তাতেই ঝগড়া শুরু করলো আমার সাথে। তোকে কতবার বলেছি, ওরা সাংবাদিক নয়, ওরা ব্যবাসয়ী। আমি উত্তরবার্তায় কাজ করি। কিন্তু যখন বিজ্ঞাপন নিয়ে গেছি সম্পাদক আমাকে নিজস্ব প্রতিনিধির চেয়েও বেশী দাম দিয়েছেন। এই কয়দিন আগেও সরকারী বিজ্ঞাপন দিয়েছি। আমাকে রাতে আকবরিয়াতে খাইয়েছেন। হোটেল ভাড়া করে রেখেছেন। এখনও অনেক বিজ্ঞাপনের বিলের কমিশন পাবো। অথচ আমি নিজে এখন বিপদে পড়েছি। আর আমার নিউজটাও দিলনা!

আমিও কম যাইনা। বললাম, ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর দাগু বাবু হত্যাকান্ডের পর দৈনিক বার্তায় আমার লেখা যে প্রতিবেদনগুলো ছাপা হতো, পরদিন দৈনিক করতোয়া হুবহু ছেপে হকাররা সে পেপার নিয়ে হেঁকে হেঁকে হাজার হাজার কপি বিক্রি করতো। অথচ সেখানে দৈনিক বার্তার কোন রেফারেন্স বা আমার নাম কিছুই থাকতো না। করতোয়া তখন ট্যাবলেট আকারে ছাপা হতো।

এটা একমাত্র টিটোরই ক্রেডিট যে, দৈনিক করতোয়া পুরো উত্তরাঞ্চল জুড়ে প্রচার পায় টিটোর লেখা বিশ্বেশ্বর দাস দাগু হত্যাকান্ডের প্রতিদিনের সাহসী আপডেট নিউজ নিয়ে। একদিন একটি নিউজসহ করতোয়া নিয়ে অফিসে গেলে এক কথাতেই আমাকে প্রতিনিধির দায়িত্ব দেন সম্পাদক। অথচ আমার বিপদে পড়ার নিউজটাই দিলনা। এটা কখনোই মানার মত নয়।

বিকেলে আমরা দু’জনে নওগাঁ ফিরে আসি। পৌরসভা থেকে সাইকেলটা নিয়ে যাই আমার বড় বোন বুলবুল আপার বাড়ী খলিসাকুড়ি। সেখানে রাত কাটিয়ে সকালে পেপারগুলো সংগ্রহ করে থ বনে যাই। দেশের সব দৈনিকে বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভার নিউজ ছাপা হয়েছে। শুধু করতোয়া ছাড়া। আসলে আমাদের যুদ্ধটা খোদ পুলিশের বিরুদ্ধে। ঐ পত্রিকাটি মনে হয় পুলিশের বিরুদ্ধে নিউজ দেয়ার সাহস করেনি তখন।

পত্রিকাগুলো নিয়ে যাই নওগাঁ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোরশেদ ভাইয়ের অফিসে। জাতীয় পার্টির নেতা ছিলেন তিনি। দাগু বাবুও ছিলেন জাতীয় পাটির মনোনীত মহাদেবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান। দাগু হত্যার পর আমার লেখা প্রতিদিনের নিউজ মোরশেদ ভাই সংগ্রহে রাখতেন। তখন থেকেই তিনি আমাকে ভালবাসতেন।দাগু হত্যাকান্ডের মূল ঘাতক কালু ডাকাতকে ধরা যাচ্ছিলনা। যেহেতু আমি প্রতিদিন আপডেট লিখছিলাম। সেহেতু একদিন কালু ডাকাতের অবস্থান আমার কাছে প্রকাশ করেন একজন। আমি বিষয়টি নওগাঁ গিয়ে মোরশেদ ভাইকে জানাই। মহাদেবপুর থানা পুলিশ তাকে শেড দিচ্ছে বলেও তাকে জানাই।

মোরশেদ ভাই বিষয়টি থানা পুলিশকে না জানিয়ে কৌশলে পুলিশ সুপারকে সঙ্গে নিয়ে রিজার্ভ ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে কালু ডাকাতকে গ্রেফতার করান। পরদিন আমার লেখা নিউজ ছাপা হয় “কালু ডাকাতকে ধরার ব্যাপারে পুলিশের বিরুদ্ধে নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ”। এটা ছাপা হবার পরদিন মহাদেবপুর থানার ৩৫জন ষ্টাফের সবাইকে ক্লোজ করা হয়।

মোরশেদ ভাইয়ের চেম্বারে ঢুকতেই হাস্যোজ্জল বদনে জানতে চান, আরে টিটো কেমন আছো ? আমি জানাই ভালো আছি ভাই। আপনার নামে একটা চিঠি আছে। দৈনিক বার্তার নিউজ এডিটর ওয়াজেদ ভাই পাঠিয়েছেন। তিনি খুশী হয়ে চিঠি নিয়ে বলেন, তাই ? আমার প্রিয় বন্ধু তিনি। ওয়াজেদ ভাইয়ের চিঠি, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর আর আমাদের মুখে সব কিছু শুনে মোরশেদ ভাই টেলিফোনে কথা বললেন নওগাঁ পুলিশ সুপারের সাথে। তারপর আমাদেরকে নিয়ে সরকারী গাড়ীযোগে তিনি এসপি অফিসের দিকে চললেন। অফিসের বাইরে আমাদেরকে রেখে তিনি একাই গেলেন এসপি অফিসে। ঘন্টাখানেক পর বেরিয়ে এসে আমাদের জানালেন, নিশ্চিন্তে বাড়ী যাও। এসপি সাহেব ডিআই-১ কে এটার দায়িত্ব দিয়েছেন। কাল সকালে তিনি মহাদেবপুর গিয়ে উভয়পক্ষকে নিয়ে বসে মিমাংসা করবেন।

পরদিন আরও অনেক পত্রিকায় বিভিন্ন স্থানে এই ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ সভার খবর প্রকাশিত হয়। প্রতিবাদ সভাগুলো থেকে দোষী পুুলিশের শাস্তি দাবী করা হয় এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার দাবী জানানো হয়।সকালে থানায় বসে কোন আলোচনা ছাড়াই আমাদেরকে একটি মিমাংসাপত্রে স্বাক্ষর করতে বলেন ডিআই-১। আমাদের প্রতিনিধি হিসাবে ফয়জুল ভাই ছিলেন। আমি আর রাজ্জাক কিসের মিমাংসা তা জানতে চাই। কারণ আমাদের তো কোন দোষই নাই। দোষ করেছে পুলিশ।

বেআইনীভাবে আমাদের ব্যবহৃত ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডার কেড়ে নিয়েছে। একটি কমপ্লিট গ্যাং রেপ মামলা এন্ট্রি করেনি। আমাদেরকে অযথা ৮ ঘন্টা থানায় আটকে রেখে মানষিক নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা এসব অন্যায়ের বিচার এবং ওসিসহ ৪ পুলিশ অফিসারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করি। কিন্তু ফয়জুল ভাইকে আমরা নেতা বানিয়ে ভূল করেছি। তারই মাসুল দিতে হলো আপসনামায় সই করে।

পুলিশ আমাদের ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডার ফেরত দিল।পরদিন বিভিন্ন কাগজে নিউজ এলো “মহাদেবপুর থানা পুলিশ অবশেষে সাংবাদিকদের ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডার ফেরত দিল”।আমরা যখন থানা ভবন থেকে বের হয়ে আসি থানা বাউন্ডারীর বাইরে তখন হাজারো উৎসুক জনতার ঢল। সবার ধারণা আমরা এবার এ্যারেষ্ট হবো। বাট আমরা ৩ জন যখন বীরদর্পে বাইরে আসলাম, মানুষ তখন আশ্চয্য হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল একধানে। অনেকের মন্তব্য, বাআপরে, এরা পুলিশকেও মানে না।

ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু অসীম সাহসী রাজ্জাক তা শেষ হতে দিল না। আমার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে বললো, করতোয়া আমাদের বিপদের খবর ছাপেনি। এতদিন তোর খবর বিক্রি করে করতোয়া চালু হলো, আর তোর বিপদের খবর দিল না ? কালকে দেখাবো মজা।

সকালেই আমাদের পিয়ন কবিরকে নিয়ে রাজ্জাক তাদের মার্কেটের সামনে রেডি হয়ে আছে। হকার লতিফ পেপারের বান্ডিল নিয়ে আসতেই রাজ্জাক হাকলো, লতিফ ভাই করতোয়া যতগুলো কপি এনেছেন সব দেন। লতিফ বলে ভাই মাসিক গ্রাহক আছে তো। রাজ্জাক এবার তাকে গাল দিল। এই কবির ধর। সবগুলো পেপার নিয়ে ম্যাচ ঠুকে আগুন ধরিয়ে দিল। সব করতোয়া পুড়ে ছাঁই হলে সবগুলোর দাম লতিফকে বুঝে দিয়ে নির্দেশ দিল কাল থেকে কোন করতোয়া আনবেন না। আমাদের এলাকায় ব্যবসায় করতে হলে আমাদের স্বার্থও আপনাকে দেখতে হবে। তার পরেও যদি নিয়ে আসেন, তাহলে আজকের মতই পরিণতি হবে। আর কাল পেপার নিতে যাবার সময় সম্পাদককে বলে আসবেন আমাদের খবর না ছাপার প্রতিবাদ করছি আমরা।টানা এক সপ্তাহ করতোয়া পুড়িয়ে দেয়া হয়।

সপ্তাহান্তে সম্পাদক লালু ভাই, সহ-সম্পাদক যাদু ভাই, বার্তা সম্পাদক আজগর ভাই, নওগাঁর বিশ্বনাথ দাস বিশু, সাদেকুল ভাইসহ একদল মোটরসাইকেল যোগে মহাদেবপুর এসে দাঁড়ান আমাদের বাড়ীতে। আমি সবাইকে বসতে দিই। মা চা বিস্কুট খাওয়ান। লালু ভাই জানতে চান কেন আমরা পেপার পোড়াচ্ছি। আমি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিই আমাদের নিউজ নিয়ে আপনার পত্রিকা বিক্রি হয়। আমরা বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করি। তারপর আমাদের বিপদ আপনি কেন দেখবেন না। আমার নিউজ ছেপেই উত্তরাঞ্চলে করতোয়া পরিচিতি পেল। কিন্তু আমরা কি পেলাম। আমার প্রশ্নের কোন জবাব দলের কেউই দিতে পারেননি।

তারা রাজ্জাকের খোঁজ করলে আমি জানাই সে হাসপাতালে গেছে। চা খেয়ে তারা উঠে মোটরসাইকেল নিয়ে সোজা চলে যান থানায়। আমিও হেঁটে যাই তাদের পিছন পিছন।থানায় গিয়ে একটি চেয়ারে বসে লালু ভাই নিজে একটি মামলার আরজি লেখেন। বাদী তিনি নিজে। আর আসামী ১ নং কিউ,এম, সাঈদ টিটো, আর ২ নং মো: আব্দুর রাজ্জাক। পুরো আরজির নীচে লালু ভাই দৈনিক করতোয়ার সম্পাদক হিসাবে স্বাক্ষর করে ওসির চেম্বারে গিয়ে তার কাছে দাখিল করেন। আমিও যাই তাদের পিছু পিছু। আমাকে দেখে ওসি স্পষ্ট ভাষায় লালু ভাইকে জানিয়ে দেন, টিটো এই ঘটনায় জড়িত নয়। এই নাম কেটে বাদ দেন। লালু ভাই বললেন, না টিটো রাজ্জাক দুজনে একই। টিটোই মেইন উদ্যোক্তা। রাজ্জাকতো তার চামচা।

লালু ভাইয়ের সাথে এতগুলো সাংবাদিক দেখেও ওসি একটুও বিচলিত হননি। তিনি শেষ পযন্ত বলেন, টিটোর নাম বাদ না দিলে আমি জিডি নিতে পারবো না।অবশেষে লালু ভাই নিজেই এক টানে আমার নাম কেটে দিতে বাধ্য হলেন। ওসি বললেন ঠিক আছে। আমি এন্ট্রি করে নিব। লালু ভাই বললেন, আমাদেরকে রিসিভ কপি দেন। জিডি নং দেন। ওসি তখন ডিউটি অফিসারকে জিডিটি এন্ট্রি করে নং সরবরাহ করতে বলেন। লালু ভাই বেরিয়ে গেলে ওসি আমাকে ডেকে বলেন, অসুবিধা নাই। রাজ্জাক ভাইকে চিন্তা করতে নিষেধ করবেন। যা করার আমিই তো করবো।

আর কিছু বলতে পারছিনা। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেছি এবার। হায়রে রাজ্জাক। থ্যাংকস। থ্যাংকস। #

আপলোডকারীর তথ্য

সম্পাদকীয় : সাংবাদিকবান্ধব নাসির ভাই<<মহাদেবপুর দর্পণ>>

প্রকাশের সময় : ০৭:৪৬:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২১

মহাদেবপুর দর্পণ, ২৬ জানুয়ারী ২০২১ :

রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক প্রাপ্ত উত্তরগ্রাম ইউপির সাবেক জনপ্রিয় চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির ভাইয়ের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। সাংবাদিকবান্ধব এই চেয়ারম্যান কিভাবে সাংবাদিকদের সহযোগিতা করেছিলেন তার একটি ঘটনা আমি লিখেছিলাম অনেক দিন আগে। তার শ্রদ্ধায় লেখাটি পূণ পত্রস্থ করা হলো :

বন্ধু আমার

কিউ,এম,সাঈদ টিটো, মহাদেবপুর (নওগাঁ), ৯ মে ২০১৮ :

এ ফ্রেন্ড ইন নিড, এ ফ্রেন্ড ইন ডিড। অথবা, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। অথবা, সুসময়ে সকলেই বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয়। এরকম আরো অনেক প্রবাদ আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, বন্ধুর প্রকৃত সঙ্গা বের করতে পারলে এসব প্রবাদ অচল। কারণ, বন্ধু মানে যে উপকার করে। আর উপকারের বদলে যে ক্ষতি করে, সে তো কখনোই বন্ধু হতে পারেনা। সে হলো শত্রু। আসলে মানুষের জীবনে এমন অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব হয়, যারা এক সময় না এক সময় উপকার করার বদলে ক্ষতি করে থাকে। একদা এক সময় সে বন্ধু থাকলেও জীবনের চরম কোন মূহুর্তে শত্রুতে পরিণত হয়। গুরুজনেরা উপদেশ দিতে পারেন, শাসন করতে পারেন, সহধর্মীনি অভিমান করতে পারে, বাট একজন বন্ধু শুধুমাত্র উপকারই করতে পারে, অন্য কিছু নয়।

আমার জীবনে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। প্রকৃত বন্ধু বলতে যা বোঝায় তার সব কিছুই ছিল, বন্ধু আমার রাজ্জাকের মধ্যে। আমার অনেক জুনিয়র হলেও সে আমার বন্ধুই ছিল। শত্রুতা হতে পারে এমন কোন কাজে সে হাত দেয়নি কখনো। আমিও না। আসলে রাজ্জাক আমার শুধু বন্ধুই নয়, সে ছিল আমার সমমনা, সহকর্মী, সহযোদ্ধা। ছিল একাধারে সাংবাদিক, সংগঠক, লেখক আর একটা দারুন সাদা মনের মানুষ। আমিই ওকে এসব বানিয়েছিলাম। সে তার প্রতিদানও দিয়েছে, আমার মত থেকে।

এক সময় টিটো, রাজ্জাক, মুনসুর ছিল মহাদেবপুরের মানিক ত্রয়ী। মানুষের উপকারে আসে এমন নতুন নতুন কাজ করাই ছিল এই ত্রয়ীর ব্রত। পরে অবশ্য অনেকেই যুক্ত হয় ত্রয়ীর সাথে। অনেকের কথা আজ বলবোনা। আজ মনে পড়ছে রাজ্জাককে নিয়ে নানান কথা। একেকটা কাহিনী অনেক বড়, চমকপ্রদ, অবিশ্বাস্য আর রোমাঞ্চকর।

সাহসী সাংবাদিক রাজ্জাক : আই সেল্যুট ইউ ফ্রেন্ড

বন্ধু আমার মো: আব্দুর রাজ্জাক, পিতা মৃত শফিউদ্দিন মন্ডল, মদিনা মার্কেট, মহাদেবপুর বাজার, মহাদেবপুর, নওগাঁ। বর্তমানে উপজেলা পশুপালন কর্মকর্তা, রাজশাহী বিমান বন্দর, নওহাটা, রাজশাহী।

১৯৮৮ সালের কথা। আমি তখন রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দেশের একমাত্র সরকারী পত্রিকা দৈনিক বার্তা আর বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক করতোয়ার মহাদেবপুর উপজেলাস্থ নিজস্ব সংবাদদাতা। এছাড়া রেডিও বাংলাদেশ রাজশাহী কেন্দ্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার। সকালের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে প্রতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার লেখা নওগাঁ জেলা সমাচার প্রচার হতো। ৫ মিনিট ব্যাপ্তি। পরবতী ৪ বছরে ৪৮টি প্রোগ্রাম ব্রডকাষ্ট হয়েছে। এজন্য আমাকে সম্মানী দেয়া হতো ৫০ টাকা। দ্বিতীয় বছরে তা উন্নীত হয় ৬৭ টাকায়। রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ি। থাকি হোষ্টেলে। বাট দিনের বেশীরভাগ সময় কাটে দৈনিক বার্তা আর ইউনিভারসিটিতে সাংবাদিকতা আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

আর রাজ্জাক বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক উত্তরবার্তার নিজস্ব সংবাদদাতা। তখন নিউজ পাঠানোর মাধ্যম ছিল ডাক হরকরা। চিঠির মাধ্যমে রাজ্জাক আমার ঠিকানায় নিউজগুলো পাঠাতো। সেগুলো আবার আমি রিরাইট করে পাঠাতাম আমার পত্রিকায়। সপ্তাহান্তে মহাদেবপুর আসতাম। তখন দু’একদিন বা তার বেশী অবস্থান করে পুরো সপ্তাহের বাকী নিউজ সংগ্রহ করে নিয়ে যেতাম।

এরই ধারাবাহিকতায় একবার রাজশাহী থেকে মহাদেবপুর এসে শুনলাম, মহাদেবপুর সমাজ কল্যাণ (এখন সমাজ সেবা) অফিসের এক ফিল্ড ওয়ার্কার, নাম স্বপন বাবু। দীর্ঘদিন ধরে মহাদেবপুরে চাকরি করে আসছে। তার অদৃশ্য খুটির জোরে তাকে কেউ অন্যত্র ট্রান্সফার করতে পারেনা। উপজেলার আখেড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু লোকের বাসায় থাকতো স্বপন বাবু লজিং। কথিত আছে যে, গৃহকর্ত্রীর সাথে তার অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরই জের ধরে গৃহস্বামী আবার তার বয়লারের এক চাতাল কন্যার সাথে অনুরুপ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। গৃহকর্ত্রী তার স্বামীকে সায়েস্তা করতে বয়লারের ঐ মহিলাকে নাজেহাল করার জন্য স্বপন বাবুকে নিয়োগ করেন।

চারদিন আগে রাতে একদল দুর্বৃত্ত ওই মহিলাকে অপহরণ করে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে উপর্যুপরী ধর্ষণ করে। পরে তার গোপনাঙ্গে গরু বাঁধার খুটা প্রবেশ করিয়ে তাকে মারাত্মক জখম করে। সকালে স্থানীয়রা অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে মহাদেবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করিয়ে দেয়। তারা মহাদেবপুর থানা পুলিশকেও বিষয়টি জানায়। কিন্তু চার দিনেও দূর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোনই ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় গ্রামের লোকেরা একটি ট্রাকে চেপে শ্লোগান দিতে দিতে উপজেলা চেয়ারম্যানের বাড়ী ধনজইল গ্রামে যায়। সেখানে তারা তদানিন্তন উপজেলা চেয়ারম্যান শ্রী ফটিক চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে লাটু বাবুর কাছে একটি স্মারক লিপি পেশ করে।

বিষয়টি জানার পর পরই কিভাবে নিউজ করবো তা নিয়ে আমি আর রাজ্জাক পরামর্শ করে নিই। রাতেই আমার শ্বাশুড়ী খন্দকার হাফেজান বেওয়াকে ম্যানেজ করে তার বড় ন্যাশনাল টেপ রেকর্ডারটি নিয়ে রাখি। সকালে ৬টি বড় ব্যাটারী কিনে টেপ রেকর্ডারটি চালু করি। কিনি নতুন একটি ক্যাসেট। সঙ্গে নিই প্রিয় ইয়াশিকা ফিক্সড ফোকাস ক্যামেরা। এবার চেপে বসি আমার বাইসাইকেলে। মাথায় ক্যাপ আর চোখে চশমা, রোদ থেকে বাঁচার জন্য। ঘারে ঝুলানো ক্যামেরা। সাইকেলের পিছনে কেরিয়ারে যথারীতি রাজ্জাক। কোলের উপর বড় টেপ রেকর্ডার।

প্রথমেই আমারা যাই মহাদেবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, যেখানে ভর্তি আছেন ভিকটিম। তার কাছে গিয়ে সব ঘটনা শুনি, দীঘসময় ধরে। হাসপাতলের বেডে তার ছবি তুলি। সাংবাদিক শুনে প্রথমে ভয় পেলেও আমরা স্থানীয়ভাবে বেশ পরিচিত জন্য জীবনের সব ঘটনা খোলা মেলা বলে ফেলেন সেই নির্যাতিত মহিলা। নির্যাতনের কাহিনী বলতে বলতে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। পুরো হাসপাতালের সবার কান সেদিকে। সকলের চোখই একসময় ভরে ওঠে কষ্টের কান্নায়।তিনি জানান, থানা পুলিশ হাসপাতালে এসে তার বক্তব্য নিয়ে গেছে।

তার কথা শুনে আমরা যাই তদানিন্তন উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসকের কাছে। তিনি জানান, মহিলাটি গ্যাং রেপের শিকার হয়েছেন। আর তার গোপনাঙ্গে খুটা প্রবেশ করানোয় প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। চিকিৎসা চলছে। তার অবস্থা এখনও আশংকাজনক। তাকে রাজশাহীতে রেফার্ড করা হয়েছে। কিন্তু তাকে সহায়তা করার মত কেউ নেই জন্য উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে অন্য কোথাও পাঠানো যায়নি।

সেখান থেকে আমরা গেলাম ঘটনাস্থলে। যে বয়লারে মহিলাটি কাজ করতেন সেখানে। তার সাথে যারা কাজ করতো তাদের সাথে কথা বলি। পুরো ঘটনা তাদের মুখে শুনে সত্যতা যাচাই করি।পাশেই ঐ প্রভাবশালী হিন্দু লোকের বাড়ী। তিনি শুধু তার এলাকায় নন, বরং পুরো মহাদেবপুরে এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। উপজেলা পরিষদের জায়গা তিনি দান করেছেন। তার দান করা জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মডেল স্কুল। কয়েকটি বয়লারের মালিক তিনি। সেখানে গিয়ে তাকে বাড়ী থেকে ডেকে নিয়ে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। তিনি আমাদেরকে কোন কথাই বলতে রাজি হননি।

আমাদেরকে তিনি খুব ভাল করেই চিনতেন। আমরা যে সাংবাদিক তাও জানতেন। কথা নেয়ার জন্য আমরা যে, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, মহাদেবপুর থানা শাখার কর্মকর্তা তাও জানাই। কিন্তু তিনি বলেন ঠিক আছে, আমারও লোক আছে এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালে। তাদের সাথে কথা বলি। তারপর আমার দরকার হলে তোমাদের সাথে কথা বলবো। তার নয়, বরং আমাদের নিউজের প্রয়োজনেই তার সাথে কথা বলতে এসেছি জানিয়ে আমরা তার কাছে শুধু জানতে চাই যে, চারদিন আগে সংঘটিত বিয়টি তিনি জানেন কিনা। তিনি জবাব দেন, এটা ভূয়া রটনা। এধরনের কোন ঘটনাই সেখানে ঘটেনি। আমরা জানাই মহিলাটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ডাক্তার বলেছেন তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। জবাবে তিনি বলেন, ওটা ব্লিডিং না। তার মাসিক হয়েছে। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম মাসিক হবার বিষয়টি আপনার জানার কথা নয়। তিনি বললেন, তার সাথে কাজ করা মহিলাদের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন। আমরা বুঝে নিলাম এ কথার মাধ্যমেই তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, ঘটনা একটা ঘটেছে এবং তিনি তা জানেনও। কিন্তু বিষয়টি আমরা তাকে বুঝতে দিলাম না।

অভিযুক্ত সমাজ কল্যাণ অফিসের ফিল্ড ওয়ার্কার এখন কোথায় জানতে চাইলে তিনি জানান, ঘটনার পর থেকে তিনি পলাতক। আসার সময় আমরা তাকে সাজেশন দিলাম নির্যাতিত মহিলাটির ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করা তারই উচিৎ। যে মাঠকর্মী তার বাড়ীতে থাকতো, তার নেতৃত্রেই দূর্বৃত্তরা ওই মহিলার উপর নির্যাতন চালায় বলে মহিলাটির অভিযোগ। নির্যাতিত মহিলার সাথে আপনার গোপন সম্পর্ক ছিল বলেও এলাকাবাসী বলছে। একথা শুনে তিনি আমাদের উপর রেগে যান। তিনি বলেন, তোমরা আমাকে হুমকি দিচ্ছ? দাঁড়াও তোমাদের বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। বলেই তিনি বাড়ীর ভিতর চলে যান।

এবার সত্যিই আমরা ভয় পাই। না জানি, বাড়ীর ভিতর থেকে লাঠি সোঠা নিয়ে লোকজন এসে আমাদের উপর চড়াও হয়। ভয়ে ভয়ে রাজ্জাকের দিকে তাকাতেই সে ইশারা করলো, চল পালাই। যে কথা, সেই কাজ। মূহুর্তে সচল হলো সাইকেল। আসার সময় সভাবসূলভভাবে রাজ্জাক ঝগড়া শুরু করলো, তোক আগেই বলেছি বেশী কথা বলার দরকার নাই। ওরা ধাবাড় দিলে সামলাতে পারতু ? আমি সাবমিশন রাখলাম, প্রধান অভিযুক্তই তিনি। তার বক্তব্য ছাড়া নিউজ হবে? যত কঠিনই হোক সে কাজ করতে পারাটাইতো সাংবাদিকের কাজ। রিস্ক না নিলে সাংবাদিক হতে পারবি ?

দু’জনে ঝগড়া করতে করতে যথাসম্ভব দ্রুত পৌছে গেলাম উপজেলা সমাজ কল্যাণ অফিসে। অফিসার স্বীকার করলেন, তার কর্মচারীটি ৪দিন ধরে আন অথারাইজ এ্যাপসেন্ট। তার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি জানান, এখনও নেয়া হয়নি। তবে আজই তিনি সোকস করবেন।

এখান থেকে আমরা গেলাম উপজেলা চেয়ারম্যানের সরকারী চেম্বারে।উপজেলা চেয়ারম্যান লাটু বাবু স্বীকার করলেন ঘটনা। বললেন, তিনি বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্মারকলিপিটি মহাদেবপুর থানার ওসি বরাবর ফরোয়ার্ড করেছেন।ইতিমধ্যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাড়ীতে এসে টেপ রেকর্ডারটি চালাই। পরীক্ষা করে দেখি পরিকল্পনা মত রাজ্জাক ঠিক সময়মত টেপ রেকর্ডার টিপেছে। সব কথাই রেকর্ড হয়েছে ঠিক ঠিক। ওকে বলি এবার বাকী শুধু থানা পুলিশের বক্তব্য নেয়া। তাহলেই লিখতে পারবো বিশাল নিউজ।দুজনে নিজ নিজ বাড়ীতে গিয়ে গোসল সেরে ভাত খেয়ে আবার বের হই।

তখন একেবারে সন্ধ্যা। মাগরিবের নামাজের পর পরই গিয়ে ঢুকি মহাদেবপুর থানায় ওসির চেম্বারে।থানার অফিসাররা সব্বাই আমাদের দুজনকে চিনতো। ওসির চেম্বারে তখন মোট ৪ জন অফিসার। আমাদেরকে বসতে বললেন। বসলাম। রাজ্জাক বসে টেপ রেকর্ডারটি রাখলো টেবিলের উপর। কথা বলতে শুরু করলে ঠিক টিপে দিয়েছিল রেকর্ড বাটনটি। সারাদিন এই কাজটি আমি খেয়াল করিনি, কিন্তু এখানে কেন জানি আড় চোখে তাকিয়ে নিশ্চিত হলাম বিষয়টি। সারা শরীর তখন শিরশির করছিল। কারণ মনে হয়, নতুন কোন এ্যাডভেঞ্চার। আমি বললাম, খুব বেশী কিছু দরকার নাই। অল্প কয়েকটা তথ্য হলেই চলবে।

ওসি বললেন, বলেন কি জানতে চান। আমি বললাম, ৪ দিন আগে আখেড়াতে একটি মহিলা রেপ হয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বিষয়টি আপনাদের নলেজে আছে কিনা ? ওসি প্রথমটায় একটু থতমত খেলেন। অন্য অফিসারদের দিকে তাকালেন। বেশ কিছুক্ষণ পর ওসি উল্টো প্রশ্ন করলেন, সেটার কি জানতে চান ? আমি বেশ সাবলিল ভাষায় বললাম, ঘটনাটা আপনারা জানেন কিনা ? সেকেন্ড অফিসার বললেন, শুনেছি। তবে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। আমার দ্বিতীয় এবং শেষ প্রশ্ন, আপনারা হাসপাতালে গিয়ে ভিকটিমের বক্তব্য নিয়েছেন কিনা ? এবার ওসি একেবারে ঘাবড়ে গেলেন। আবার কিছুক্ষণ দেরী। আবার তাকালেন অন্য অফিসারদের দিকে। আবার সেই সেকেন্ড অফিসার বললেন, হ্যাঁ। তার সাথে কথা বলেছি। তবে তা আন অফিসিয়ালী। আমি সন্তুষ্ট হয়ে বললাম, ঠিক আছে। আমার আর কোন প্রশ্ন নেই। থ্যাংক ইউ। চল রাজ্জাক।

আমি চলে আসতে চাইলাম ঠিকই। কিন্তু মনে হচ্ছিল আসতে পারছিলাম না। পুরো চেম্বার জুড়ে একটা থমথমে ভাব। মন বেশ উৎফুল্ল। মনে হচ্ছিল বিশাল কোন অসাধ্য সাধন করে ফেলেছি। কিন্তু ঘরের অন্য সবাই যেন অস্বস্তিতে। পিন পতন নিস্তব্ধতা। ঠিক এই সময় রাজ্জাক রেকর্ড করা বন্ধ করার জন্য আবার সেই বাটনে টিপ দিল। শব্দ হলো খটাশ করে। বাটনটি শব্দ করে উঠে গেল। রাজ্জাক আর আমি এক সাথেই উঠে দাঁড়ালাম ফিরে আসার জন্য। দরজার কাছে চলে আসলাম। ঠিক এই সময়ই টনক নড়লো পুলিশের। ওসি বললেন, একটু দাঁড়ান। বসেন চা খেয়ে যান।

থমকে দাঁড়ালাম আমরাও। কিন্তু ফিরতে চাইনা। ওসিও নাছোর বান্দা। বার বার বলে আমাদেরকে বসতে বাধ্য করালেন। চা এলো। কিন্তু আমাদের মন অন্যদিকে। এখান থেকে বেরুতে পারলেই নিউজ। সেকেন্ড অফিসার বললেন, দেখি কি রেকর্ড করলেন। আমি বললাম, আপনারা যা বলেছেন তাই রেকর্ড হয়েছে। এটা করার রাইট আমাদের আছে। এটা আমাদের পেশার সাথে সম্পৃক্ত। রিয়োন্ড বাটন চেপে আবার প্লে করে সবাই শুনলেন। এবার পুলিশেরা অন্যরকম আচরন শুরু করলো।

তারা সবাই আরও ভিতরে গোপন চেম্বারে গিয়ে পরামর্শ করতে লাগলেন। আশে পাশে কেউ নেই দেখে রাজ্জাকের দিকে তাকালাম। রাজ্জাক বললো, মনে হয় ভয় পাইছে। আমি বললাম, ঠিক। এই দুটা প্রশ্নেই ওরা বুঝে গেছে, ঘটনার ৪ দিন পরেও মামলা হয়নি। এ খবর ছাপা হলে ওদের চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে।ইতিমধ্যে সেকেন্ড অফিসার এসে আমাদের সার্চ করে ক্যামেরাটাও নিয়ে নিলেন। বাড়ীতে গিয়ে ভাগ্যিস আগের ক্যাসেটটা রেখে আবার একটা নতুন ক্যাসেট কিনে এনেছিলাম। না হলে আগের রেকর্ডগুলোও তাদের হাতে চলে যেত। মনে মনে নিজেদের গোয়েন্দাগীরির প্রশংসা করতে ইচ্ছে হলো।অফিসাররা দীর্ঘক্ষণ নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলেন। রেডিও রুমে গিয়ে পুলিশ সুপারের সাথে ওয়ারলেসে পরামর্শ করলেন।

ঘন্টাখানেক পর উত্তরগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান নাসির ভাই ওসির চেম্বারে আসলেন। আমাদেরকে দেখে কি ঘটনা শুনলেন। সব শুনে তিনি গোপন চেম্বারে গেলেন। আধাঘন্টা পর তিনি বেরিয়ে এসে আমাদেরকে বললেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ। তোমাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। শুনে আমি প্রকাশ্যে খুব ক্ষেপে গেলাম। হঠাৎ করেই রেগে যাওয়া ছিল আমার বদ অভ্যাস। বললাম, কি বলেন নাসির ভাই। আমরা কি চোর নাকি ? আমরা সাংবাদিক। যে কারও বক্তব্য রেকর্ড করার অধিকার আমাদের আছে। আমরা কি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ গোপণীয় কিছু রেকর্ড করেছি, যেটা ফাঁস হলে রাষ্ট্রের ক্ষতি হবে ? এত বড় একটা ঘটনা, পুলিশ ৪ দিন ধরে ধামা চাপা দিয়ে রেখেছে, এটা কি আইন এ্যালাও করে ? নাসির ভাই বললেন, অনুমতি না নিয়ে বক্তব্য রেকর্ড করা অন্যায় হয়েছে। আমি বললাম, এত বড় টেপ রেকর্ডার, তার উপর রাজ্জাক তা রেখেছে একদম চোখের সামনে টেবিলের উপর। এটাতে রেকর্ড করা তারাও তো দেখেছে। এটা গোপণীয় হয় কিভাবে ? ঠিক আছে, না বলে বক্তব্য রেকর্ড করা অন্যায় কোন আইনে ? সে আইন দেখাক।

নাসির ভাই এবার একটু নরম হলেন। বুঝলেন আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে লাভ হবেনা। তিনি বললেন, টিটো ঝামেলা করে লাভ নাই। ওসি সাহেব বললেন যে তোমরা ভূল শিকার করে একটা চিরকুটে সই করে এখান থেকে বের হয়ে যাও। মামলা থেকে বাঁচো। আমি পরে তোমাদের সাথে দেখা করছি।মনে পড়লো নাসির ভাই আসলে নির্বাচিত ও জনপ্রিয় চেয়ারম্যান হলেও এখন থানার একজন মিডিয়া। এখানে এ পেশাটা খুব দাপটের। অনেক প্রভাবশালীই মিডিয়াগীরি করেছেন। আমি বললাম দেখি আমরা একটু পরামর্শ করি।নাসির ভাই বাইরে গেলেন।

আমি আর রাজ্জাক চুপচাপ আরও প্রায় একঘন্টা বসে থাকলাম। অধৈর্য হয়ে গেছি। ক্ষুধা লাগছে। বারে বারে নাসির ভাইয়ের হুমকির কথা মনে হচ্ছিল। মামলা হলে তো মুশকিল। দু’জনে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বুঝলাম দু’জনেই শারীরীক ও মানসিকভাবে ভীষণ ক্লান্ত। এখান থেকে যে কোন উপায়ে এখন বের হওয়া দরকার। মামলাকে আমি ভয় করিনা। কিন্তু রাজ্জাক নতুন ছেলে। তার বিরুদ্ধে মামলা হলে তার অভিভাবকেরা সব দায় চাপাবে আমার উপর। মনে মনে চাচ্ছিলাম, অন্তত রাজ্জাক বেরিয়ে যাক। আমার একার বিরুদ্ধে মামলা হোক। রাজ্জাক গিয়ে বাড়ীতে খবর দিতে পারবে। জামিন টামিন করাতে পারবে।

ডাকলাম, রাজ্জাক। রাজ্জাক কোন কথা না বলে বিরক্তি প্রকাশ করে ঠোট উল্টিয়ে ইঙ্গিতে জবাব দিল। আমি বললাম, লে না হয়, ভূল শিকার করে সই দিয়ে এখান থেকে পালায়ে বাঁচি। না হলে যদি মামলা দেয় তো জেল হাজাতে যাওয়া লাগবে। পুলিশের সাথে মামলা। জামিন হবেনা। রাজ্জাক মুখ কিষ্টা মিষ্টা করে মেজাজ গড়ম করে এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনলো। আমার কথা শেষ হতে না হতেই চেঁচিয়ে উঠলো, হারামজাদা, তুই সই দে। আমার বের হওয়া লাগবেনা। দেখি কয়টা মামলা দিতে পারে।

যাশ সর্বোনাশ। বলে কি ? ব্রেভো। মুখে কিছু বললাম না। কিন্তু মনে মনে অনেক কিছুই ভাবলাম। মনে হলো প্রকৃতপক্ষে রাজ্জাককেই থাকা লাগতো আমার জায়গায়। আর আমি রাজ্জাকের জায়গায়। আমি সাংবাদিকতা শুরু করি এই ঘটনার প্রায় ১০ বছর আগে ১৯৭৯ সালে। তখন আমি প্রথম বিভাগে এসএসসি পাশ করে জাহাঙ্গীরপুর কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হই। আমার খালু কাজী সাহের উদ্দিন আহমেদের মালিকানায় কাজী লাইব্রেরীতে পেপার বিলির চাকরি নিই। মানে হকারী করি। নওগাঁ জেলার প্রথম হকার আমি। তখন ঢাকা থেকে ইত্তেফাক ৬০ কপি আর রাজশাহী থেকে দৈনিক বার্তা ৪০ কপি আসতো ডাকযোগে। ইত্তেফাক ২ দিন পর আর দৈনিক বার্তা আসতো ১ দিন পর। দুপুরে কলেজ থেকে ফিরে সোজা পোষ্ট অফিসে গিয়ে পেপার নিয়ে এসে সাইকেলযোগে গ্রাহকদের বাড়ী পৌঁছে দেয়া ছিল আমার কাজ। বিনিময়ে ৩ বেলা খাবার আর মাসে ১০০ টাকা বেতন পেতাম। পেপার বিলি শেষে পেপার পড়া থেকেই সাংবাদিকতা, ছড়া লেখা আর সংগঠন করা শিখেছি আমি।

রাজ্জাক সাংবাদিকতায় আমার চেয়ে অনেক জুনিয়র। আমার কাছ থেকে শিখছে সে। কিন্তু তার সাহসীকতায় আমি মুগ্ধ। বিপদ জেনেও দারুণ কনফিডেন্স তার। নিজের প্রতি এই আস্থা, বিশ্বাস আর লোভে না পড়া কয়জন পারে ? থ্যাংকস। আই সেল্যুট ইউ ফ্রেন্ড।

অবশেষে নাসির চেয়ারম্যান আর সব পুলিশ অফিসার আবার এলেন আমাদের সামনে। এবার পুলিশ আমাদের জেরা শুরু করলো। কোন দল করেন ? আমি বললাম দৈনিক বার্তা সরকারী পেপার। রেডিও ও সরকারী। দু’জনের পুরো বায়োডাটা নিয়ে আইনের বইয়ের একটার পর একটা পাতা উল্টাতে লাগলেন ওসি।

নাসির ভাই বললেন, রাজ্জাক তোমরা কি ভূল স্বীকার করবে। আমরা দু’জনেই চুপ থাকলাম। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, আমরা কি ভূল করেছি সেটা বলেন। নাসির ভাই আবার বললেন, অনুমতি না নিয়ে কথা রেকর্ড করা। রাজ্জাক বললো, ঠিক আছে আমরা যদি ভূল করে থাকি, তাহলে ভূল স্বীকার করবো, ক্ষমাও চাইবো। কিন্তু সে আইনটা আপনি দেখান। যদি বক্তব্য রেকর্ড করার অধিকার না থাকে তাহলে তো সাংবাদিকতাই করা যাবেনা। ঠিক আছে, আইনে থাকলে সাংবাদিকতা করবোনা।

নাসির ভাই অধৈর্য হয়ে বললেন, আসলে তোমরা সমাধান চাচ্ছনা। আমার আর কিছু বলার নাই ওসি সাহেব। তবে নাসির ভাই শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে ছেড়ে দেবার সুপারিশ করেন। নাসির ভাই বেরিয়ে গেলে, সেকেন্ড অফিসার বললেন, আমরা আপনাদের ক্যামেরা আর টেপ রেকর্ডার সীজ করে রাখলাম। আপনারা এখন আসুন। রাজ্জাক বললো, আমাদেরকে সীজার লিষ্ট দেন। সেকেন্ড অফিসার একটা সাদা কাগজে সীজার লিষ্ট তৈরী করে আমাদেরকে সই করতে বললেন। রাজ্জাক বললো আরো এক কপি করে আমাদেরকে দেন। অগত্যা পুলিশ তাই করলো।

৮ঘন্টা থানায় আটক থাকার পর অবশেষে আমরা ছাড়া পেলাম রাত ২টায়।থানা থেকে বেরিয়ে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু অসন্তুষ্ট নই। যেন কোন ক্লান্তিই নেই আমাদের। বরং পুলিশের এই দূর্ব্যবহারের জবাব কিভাবে দিব, তাই ভাবছি কেবল। এখন বুঝছি, যারা অন্যায় করে ভয় তাদেরই থাকে। আর যারা কোনদিন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়না, তাদের শির থাকে সব সময় চীর উন্নত। অন্যায়কারী পুলিশই হোক আর বিশাল লাঠিয়াল বাহিনীর নেতা হোক সৎ লোকেরা তাদেরকে ভয় পাবে কেন ? আসলে সৎ থাকার যে একটা তৃপ্তি, স্বাদ, আনন্দ এটা এখনকার কোন সাংবাদিক পেয়েছেন কিনা আমার সন্দেহ আছে।

রাজ্জাক ওর বাড়ী গেলনা। গেল আমার সাথে আমার ভায়রা সিরাজ ভাইয়ের বাড়ীতে। সেখানেই একটি রুমে আমি আর আমার স্ত্রী শিউলী ভাড়া থাকতাম। জানালা দিয়ে ডাকলাম শীলুমনি, খোল। আমাদেরকে ভাত খেতে বললো। আমরা খেতে পারলাম না। সারাদিনের কোন ক্লান্তিই যেন নেই আমাদের। বাসা থেকে সাইকেলটি নিয়ে রাতেই আবার বেরিয়ে পড়লাম দু’জন।ডবল সাইকেল চালিয়ে ভোর ৬টায় পৌঁছে গেলাম নওগাঁ পৌরসভায়। সেখানকার নাইট গার্ডকে ডেকে সাইকেলটি অফিসে রাখতে বললাম। আমার দুলাভাই খন্দকার আব্দুল হাই তখন সে পৌরসভার সেক্রেটারী ছিলেন। বললাম দুলাভাইকে বলবেন, আপনার শালাবাবু সাইকেল রেখে ট্রেনযোগে রাজশাহী গেছে। ফিরে এসে সাইকেল নিবে।

দুলাভাই মারা গেছেন। বাট আমাকে অনেক অনেক ভালবাসতেন তিনি। তার কথা মনে হলে একজন সৎ মানুষের অবয়ব ভেঁসে উঠে চোখের সামনে।

এবার আমরা রিক্সাযোগে সান্তাহার রেলষ্টেশন। আর ভোর ৭টায় উত্তরা এক্সপ্রেসযোগে এক্কেবারে রাজশাহী পৌঁছলাম দুপুরে। আমার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের হোষ্টেলে গিয়ে ফ্রেস হয়ে সন্ধ্যায় গেলাম দৈনিক বার্তা অফিসে।

তখন নিউজ এডিটর ছিলেন ওয়াজেদ মাহমুদ। অত্যন্ত অধ্যবসায়ী, রিজার্ভ আর সাহসী সাংবাদিক ছিলেন তিনি। মফস্বলের সবাই আমরা তাকে শ্রদ্ধা করতাম, ভয় করতাম। হাতে কলমে ক খ করে আমাদেরকে সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন তিনি। তার একদিনের কথা আমার খুব কানে বাজে। তিনি অনেকের সামনে খুব জোড়ে শব্দ করে বলেছিলেন, এই কি হয়েছে, টিটোকে আমি পছন্দ করে প্রতিনিধি বানিয়েছি। ১৯৮৫ সালে মহাদেবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান শ্রী বিশ্বেশ্বর দাস দাগু হত্যাকান্ডের পর দৈনিক বার্তার প্রথম পাতায় “তদন্ত রিপোর্ট : বিশ্বেশ্বর দাস কেন খুন হলেন” কিউ,এম,সাঈদ টিটো, শিরোণামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর দৈনিক বার্তা অফিসে আমি গেলে আমাকে নিয়ে ডেস্কের সকলে হৈ চৈ করতে থাকলে এভাবে তিনি সকলকে থামান।

তখন সকলের কথা ছিল টিটো এত সাহস করলো কেন। খুনি কালু ডাকাত, ৯ ইউপি চেয়ারম্যান, টিএনও আর এত বাঘা বাঘা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে লিখেছে, তার লেখার পর পরই তারা এ্যারেষ্ট হয়েছে। ওরা জেল থেকে বেরুলে টিটোর উপর একশন নিবে তো। টিটোকে তখন কে সেভ করবে। দাগু বাবুর মত সেও তো মার্ডার হবে।

ওয়াজেদ ভাইয়ের একই কথা। সাংবাদিকদের এসব পরিণতির কথা ভাবলে কোন নিউজই লেখা যাবেনা। যেখানে যা ঘটছে সেটা নির্দিধায় লেখতে পারাটাই সাংবাদিকতা। সত্য ঘটনা লেখার পর কি ঘটতে পারে তা নিয়ে ভাবার দরকার নাই। সময়ই বলে দিবে কি করতে হবে। আই অলসো সেল্যুট হিম। সে সময় প্রতিদিন দাগু হত্যা মামলার আপডেট ছাপা হতো। খোদ রাজশাহীতে সে খবর সবাইকে জানাতে একটি গ্রুপ দেয়ালে পেপার সাটানো শুরু করে। লাল কালিতে দাগানো থাকতো দাগু হত্যা মামলার আপডেট নিউজ।

পরবর্তীতে ওয়াজেদ ভাই দৈনিক সোনালী সংবাদের প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। তখন দৈনিক সোনালী সংবাদের মহাদেবপুর প্রতিনিধি ছিল অসিত দাস। অফিসে ইফতার পার্টিতে অসিত আমাকেসহ রাজশাহী আসে। আমি আর অসিত সম্পাদক ওয়াজেদ ভাইয়ের চেম্বারে ঢুকি। এটা আমার সাথে তার দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ। আমাকে দেখেই তড়িঘড়ি চেয়ার থেকে ওঠে এসে ওয়াজেদ ভাই আমাকে বুকে টেনে নেন। যথাসাধ্য জোড় গলায় বলতে থাকেন, এই কে আছো, দেখো, দেখো আমার ভাই এসেছে।

মূহুর্তে আমার চোখ ছলছল করে ওঠে। টুপ করে নীরবে গড়িয়ে পড়ে পানি। শ্রদ্ধার নতজানু হয় মাথা।ওয়াজেদ ভাইয়ের কাছে মহাদেবপুরের সব খুলে বলি। তিনি বলেন, নিউজটা লেখ। আমি নিউজ লিখি নিজস্ব সংবাদদাতা, মহাদেবপুর (নওগাঁ) ডেটলাইনে। নিউজ দেখে ওয়াজেদ ভাই বলেন, তোমার নিউজ তুমি লেখবা কিভাবে। আমি বললাম, ভাই আপনি তো আমাকেই লিখতে বললেন। ওয়াজেদ ভাই চীফ রিপোর্টার কাজল ভাইকে ডেকে বললেন নিউজটা তোমার নামে ব্যাক পেজে ছেড়ে দাও।

পরদিন সকালে দৈনিক বার্তার ব্যাক পেজে ষ্টাফ রিপোর্টারের ডেটলাইনে ছাপা হলো “মহাদেবপুর থানা পুলিশ সাংবাদিকদের ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডার কেড়ে নিয়েছে”। নিউজে মহিলাটির রেপসহ ডিটেইলস আছে।কয়েকটি পেপার কিনে নিয়ে সকালে আবার গেলাম দৈনিক বার্তায়। ওয়াজেদ ভাই একটি চিঠি লিখে দিলেন। বললেন, এই চিঠি নিয়ে গিয়ে দিবে নওগাঁ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ,কে,এম, মোরশেদকে। তিনি আমার বন্ধু মানুষ। তিনি যা বলেন, তাই করবে যাও। তিনি বললেন, রাজশাহীর ডিআইজি নিউজ দেখে তার সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন। ডিআইজি নওগাঁর পুলিশ সুপারকে বিষয়টি দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।

রাজশাহী থেকে আমি আর রাজ্জাক বাসযোগে গেলাম বগুড়া। রাতে দৈনিক করতোয় অফিসে গিয়ে সব খুলে বললাম সম্পাদক মোজাম্মেল হক লালু ভাইকে। নিউজ লিখে দিলাম। একটা দৈনিক বার্তা দিলাম।এরপর গেলাম রাজ্জাকের দৈনিক উত্তরবার্তা অফিসে। এর সম্পাদক মাহবুবুর রহমান ছিলেন আমার খুব প্রিয়, সৎ সাংবাদিক আর ভালো সংগঠক। একটি নিউজের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় তিনি জেলে গিয়েছিলেন। আমারা তার মুক্তির জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছি। তার কাছে রাজ্জাকের পক্ষে আমিই বিষয়টি খুলে বলি। তিনি নিউজ এডিটর সিদ্দিক ভাইকে ডেকে দৈনিক বার্তার নিউজ হুবহু ছাপতে বলেন।

এক্ষেত্রে উত্তরবার্তা আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। নিউজের শেষে টেলিফোনে নওগাঁর পুলিশ সুপারের বক্তব্য নিয়ে তা ছেপে দেয় এ পত্রিকাটি। পুলিশ সুপার বলেছিলেন, মহাদেবপুর থানার ওসি বলেছেন যে, তারা যে সাংবাদিক সেই পরিচয় দেয়নি। বরং তারা থানার সিকিউরিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে জানতে চেয়েছে কতজন ফোর্স আছে এখানে। তারা সর্বহারা দলের জঙ্গী হতে পারে বলে পুলিশের সন্দেহ এবং ইতিমধ্যেই তাদের বিরুদ্ধে থানা পুলিশ মামলা দায়ের করেছে বলেও জানান পুলিশ সুপার।

রাতে বগুড়াতেই থাকলাম। সকালে দৈনিক করতোয়া আর দৈনিক উত্তরবার্তা সংগ্রহ করলাম। উত্তরবার্তার কাভারেজ দেখে খুবই ভালো লাগলো। সম্পাদক নিজে এখানে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অথচ করতোয়া ? এর চরিত্র দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায়না। এই এত চাঞ্চল্যকর ঘটনার কোন নিউজই দেয়নি পত্রিকাটি। করতোয়া দেখে রাজ্জাক আবার রাস্তাতেই ঝগড়া শুরু করলো আমার সাথে। তোকে কতবার বলেছি, ওরা সাংবাদিক নয়, ওরা ব্যবাসয়ী। আমি উত্তরবার্তায় কাজ করি। কিন্তু যখন বিজ্ঞাপন নিয়ে গেছি সম্পাদক আমাকে নিজস্ব প্রতিনিধির চেয়েও বেশী দাম দিয়েছেন। এই কয়দিন আগেও সরকারী বিজ্ঞাপন দিয়েছি। আমাকে রাতে আকবরিয়াতে খাইয়েছেন। হোটেল ভাড়া করে রেখেছেন। এখনও অনেক বিজ্ঞাপনের বিলের কমিশন পাবো। অথচ আমি নিজে এখন বিপদে পড়েছি। আর আমার নিউজটাও দিলনা!

আমিও কম যাইনা। বললাম, ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর দাগু বাবু হত্যাকান্ডের পর দৈনিক বার্তায় আমার লেখা যে প্রতিবেদনগুলো ছাপা হতো, পরদিন দৈনিক করতোয়া হুবহু ছেপে হকাররা সে পেপার নিয়ে হেঁকে হেঁকে হাজার হাজার কপি বিক্রি করতো। অথচ সেখানে দৈনিক বার্তার কোন রেফারেন্স বা আমার নাম কিছুই থাকতো না। করতোয়া তখন ট্যাবলেট আকারে ছাপা হতো।

এটা একমাত্র টিটোরই ক্রেডিট যে, দৈনিক করতোয়া পুরো উত্তরাঞ্চল জুড়ে প্রচার পায় টিটোর লেখা বিশ্বেশ্বর দাস দাগু হত্যাকান্ডের প্রতিদিনের সাহসী আপডেট নিউজ নিয়ে। একদিন একটি নিউজসহ করতোয়া নিয়ে অফিসে গেলে এক কথাতেই আমাকে প্রতিনিধির দায়িত্ব দেন সম্পাদক। অথচ আমার বিপদে পড়ার নিউজটাই দিলনা। এটা কখনোই মানার মত নয়।

বিকেলে আমরা দু’জনে নওগাঁ ফিরে আসি। পৌরসভা থেকে সাইকেলটা নিয়ে যাই আমার বড় বোন বুলবুল আপার বাড়ী খলিসাকুড়ি। সেখানে রাত কাটিয়ে সকালে পেপারগুলো সংগ্রহ করে থ বনে যাই। দেশের সব দৈনিকে বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভার নিউজ ছাপা হয়েছে। শুধু করতোয়া ছাড়া। আসলে আমাদের যুদ্ধটা খোদ পুলিশের বিরুদ্ধে। ঐ পত্রিকাটি মনে হয় পুলিশের বিরুদ্ধে নিউজ দেয়ার সাহস করেনি তখন।

পত্রিকাগুলো নিয়ে যাই নওগাঁ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোরশেদ ভাইয়ের অফিসে। জাতীয় পার্টির নেতা ছিলেন তিনি। দাগু বাবুও ছিলেন জাতীয় পাটির মনোনীত মহাদেবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান। দাগু হত্যার পর আমার লেখা প্রতিদিনের নিউজ মোরশেদ ভাই সংগ্রহে রাখতেন। তখন থেকেই তিনি আমাকে ভালবাসতেন।দাগু হত্যাকান্ডের মূল ঘাতক কালু ডাকাতকে ধরা যাচ্ছিলনা। যেহেতু আমি প্রতিদিন আপডেট লিখছিলাম। সেহেতু একদিন কালু ডাকাতের অবস্থান আমার কাছে প্রকাশ করেন একজন। আমি বিষয়টি নওগাঁ গিয়ে মোরশেদ ভাইকে জানাই। মহাদেবপুর থানা পুলিশ তাকে শেড দিচ্ছে বলেও তাকে জানাই।

মোরশেদ ভাই বিষয়টি থানা পুলিশকে না জানিয়ে কৌশলে পুলিশ সুপারকে সঙ্গে নিয়ে রিজার্ভ ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে কালু ডাকাতকে গ্রেফতার করান। পরদিন আমার লেখা নিউজ ছাপা হয় “কালু ডাকাতকে ধরার ব্যাপারে পুলিশের বিরুদ্ধে নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ”। এটা ছাপা হবার পরদিন মহাদেবপুর থানার ৩৫জন ষ্টাফের সবাইকে ক্লোজ করা হয়।

মোরশেদ ভাইয়ের চেম্বারে ঢুকতেই হাস্যোজ্জল বদনে জানতে চান, আরে টিটো কেমন আছো ? আমি জানাই ভালো আছি ভাই। আপনার নামে একটা চিঠি আছে। দৈনিক বার্তার নিউজ এডিটর ওয়াজেদ ভাই পাঠিয়েছেন। তিনি খুশী হয়ে চিঠি নিয়ে বলেন, তাই ? আমার প্রিয় বন্ধু তিনি। ওয়াজেদ ভাইয়ের চিঠি, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবর আর আমাদের মুখে সব কিছু শুনে মোরশেদ ভাই টেলিফোনে কথা বললেন নওগাঁ পুলিশ সুপারের সাথে। তারপর আমাদেরকে নিয়ে সরকারী গাড়ীযোগে তিনি এসপি অফিসের দিকে চললেন। অফিসের বাইরে আমাদেরকে রেখে তিনি একাই গেলেন এসপি অফিসে। ঘন্টাখানেক পর বেরিয়ে এসে আমাদের জানালেন, নিশ্চিন্তে বাড়ী যাও। এসপি সাহেব ডিআই-১ কে এটার দায়িত্ব দিয়েছেন। কাল সকালে তিনি মহাদেবপুর গিয়ে উভয়পক্ষকে নিয়ে বসে মিমাংসা করবেন।

পরদিন আরও অনেক পত্রিকায় বিভিন্ন স্থানে এই ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ সভার খবর প্রকাশিত হয়। প্রতিবাদ সভাগুলো থেকে দোষী পুুলিশের শাস্তি দাবী করা হয় এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার দাবী জানানো হয়।সকালে থানায় বসে কোন আলোচনা ছাড়াই আমাদেরকে একটি মিমাংসাপত্রে স্বাক্ষর করতে বলেন ডিআই-১। আমাদের প্রতিনিধি হিসাবে ফয়জুল ভাই ছিলেন। আমি আর রাজ্জাক কিসের মিমাংসা তা জানতে চাই। কারণ আমাদের তো কোন দোষই নাই। দোষ করেছে পুলিশ।

বেআইনীভাবে আমাদের ব্যবহৃত ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডার কেড়ে নিয়েছে। একটি কমপ্লিট গ্যাং রেপ মামলা এন্ট্রি করেনি। আমাদেরকে অযথা ৮ ঘন্টা থানায় আটকে রেখে মানষিক নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা এসব অন্যায়ের বিচার এবং ওসিসহ ৪ পুলিশ অফিসারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করি। কিন্তু ফয়জুল ভাইকে আমরা নেতা বানিয়ে ভূল করেছি। তারই মাসুল দিতে হলো আপসনামায় সই করে।

পুলিশ আমাদের ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডার ফেরত দিল।পরদিন বিভিন্ন কাগজে নিউজ এলো “মহাদেবপুর থানা পুলিশ অবশেষে সাংবাদিকদের ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডার ফেরত দিল”।আমরা যখন থানা ভবন থেকে বের হয়ে আসি থানা বাউন্ডারীর বাইরে তখন হাজারো উৎসুক জনতার ঢল। সবার ধারণা আমরা এবার এ্যারেষ্ট হবো। বাট আমরা ৩ জন যখন বীরদর্পে বাইরে আসলাম, মানুষ তখন আশ্চয্য হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল একধানে। অনেকের মন্তব্য, বাআপরে, এরা পুলিশকেও মানে না।

ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু অসীম সাহসী রাজ্জাক তা শেষ হতে দিল না। আমার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে বললো, করতোয়া আমাদের বিপদের খবর ছাপেনি। এতদিন তোর খবর বিক্রি করে করতোয়া চালু হলো, আর তোর বিপদের খবর দিল না ? কালকে দেখাবো মজা।

সকালেই আমাদের পিয়ন কবিরকে নিয়ে রাজ্জাক তাদের মার্কেটের সামনে রেডি হয়ে আছে। হকার লতিফ পেপারের বান্ডিল নিয়ে আসতেই রাজ্জাক হাকলো, লতিফ ভাই করতোয়া যতগুলো কপি এনেছেন সব দেন। লতিফ বলে ভাই মাসিক গ্রাহক আছে তো। রাজ্জাক এবার তাকে গাল দিল। এই কবির ধর। সবগুলো পেপার নিয়ে ম্যাচ ঠুকে আগুন ধরিয়ে দিল। সব করতোয়া পুড়ে ছাঁই হলে সবগুলোর দাম লতিফকে বুঝে দিয়ে নির্দেশ দিল কাল থেকে কোন করতোয়া আনবেন না। আমাদের এলাকায় ব্যবসায় করতে হলে আমাদের স্বার্থও আপনাকে দেখতে হবে। তার পরেও যদি নিয়ে আসেন, তাহলে আজকের মতই পরিণতি হবে। আর কাল পেপার নিতে যাবার সময় সম্পাদককে বলে আসবেন আমাদের খবর না ছাপার প্রতিবাদ করছি আমরা।টানা এক সপ্তাহ করতোয়া পুড়িয়ে দেয়া হয়।

সপ্তাহান্তে সম্পাদক লালু ভাই, সহ-সম্পাদক যাদু ভাই, বার্তা সম্পাদক আজগর ভাই, নওগাঁর বিশ্বনাথ দাস বিশু, সাদেকুল ভাইসহ একদল মোটরসাইকেল যোগে মহাদেবপুর এসে দাঁড়ান আমাদের বাড়ীতে। আমি সবাইকে বসতে দিই। মা চা বিস্কুট খাওয়ান। লালু ভাই জানতে চান কেন আমরা পেপার পোড়াচ্ছি। আমি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিই আমাদের নিউজ নিয়ে আপনার পত্রিকা বিক্রি হয়। আমরা বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করি। তারপর আমাদের বিপদ আপনি কেন দেখবেন না। আমার নিউজ ছেপেই উত্তরাঞ্চলে করতোয়া পরিচিতি পেল। কিন্তু আমরা কি পেলাম। আমার প্রশ্নের কোন জবাব দলের কেউই দিতে পারেননি।

তারা রাজ্জাকের খোঁজ করলে আমি জানাই সে হাসপাতালে গেছে। চা খেয়ে তারা উঠে মোটরসাইকেল নিয়ে সোজা চলে যান থানায়। আমিও হেঁটে যাই তাদের পিছন পিছন।থানায় গিয়ে একটি চেয়ারে বসে লালু ভাই নিজে একটি মামলার আরজি লেখেন। বাদী তিনি নিজে। আর আসামী ১ নং কিউ,এম, সাঈদ টিটো, আর ২ নং মো: আব্দুর রাজ্জাক। পুরো আরজির নীচে লালু ভাই দৈনিক করতোয়ার সম্পাদক হিসাবে স্বাক্ষর করে ওসির চেম্বারে গিয়ে তার কাছে দাখিল করেন। আমিও যাই তাদের পিছু পিছু। আমাকে দেখে ওসি স্পষ্ট ভাষায় লালু ভাইকে জানিয়ে দেন, টিটো এই ঘটনায় জড়িত নয়। এই নাম কেটে বাদ দেন। লালু ভাই বললেন, না টিটো রাজ্জাক দুজনে একই। টিটোই মেইন উদ্যোক্তা। রাজ্জাকতো তার চামচা।

লালু ভাইয়ের সাথে এতগুলো সাংবাদিক দেখেও ওসি একটুও বিচলিত হননি। তিনি শেষ পযন্ত বলেন, টিটোর নাম বাদ না দিলে আমি জিডি নিতে পারবো না।অবশেষে লালু ভাই নিজেই এক টানে আমার নাম কেটে দিতে বাধ্য হলেন। ওসি বললেন ঠিক আছে। আমি এন্ট্রি করে নিব। লালু ভাই বললেন, আমাদেরকে রিসিভ কপি দেন। জিডি নং দেন। ওসি তখন ডিউটি অফিসারকে জিডিটি এন্ট্রি করে নং সরবরাহ করতে বলেন। লালু ভাই বেরিয়ে গেলে ওসি আমাকে ডেকে বলেন, অসুবিধা নাই। রাজ্জাক ভাইকে চিন্তা করতে নিষেধ করবেন। যা করার আমিই তো করবো।

আর কিছু বলতে পারছিনা। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে গেছি এবার। হায়রে রাজ্জাক। থ্যাংকস। থ্যাংকস। #