মহাদেবপুর দর্পণ, এম, রইচ উদ্দিন, স্টাফ রিপোর্টার, পোরশা (নওগাঁ), ৬ জুলাই ২০২১ :
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত বাবার লাশ পাহারা দেওয়ার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া সেই শিশু কন্যার পরিবারে আর্থিক অনুদান দিলেন নওগাঁর পোরশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুল হামিদ রেজা।
নওগাঁ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে প্রাপ্ত অনুদানের নগদ ১০ হাজার টাকা ইউএনও মঙ্গলবার (৬ জুলাই) সকালে উপজেলার নিতপুর কলোনীপাড়া গ্রামে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়অ মজিবর রহমানের বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রীর হাতে তুলে দেন। এসময় উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) জাকির হোসেন তার সাথে ছিলেন।তানজিলা বেগমের ভাই আলমগীর হোসেন জানান, তার ভগ্নিপতি মজিবুর রহমান পেশায় একজন ফেরিওয়ালা ছিলেন। ভ্যানে করে মেলামাইন ও সিরামিকসামগ্রী ফেরি করে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করতেন। বাস্তুভিটা ছাড়া তার আর কোনো সহায় সম্পদ নেই। সাত দিন ধরে তিনি সর্দি-জ্বরে ভুগছিলেন। গত রোববার (৪ জুলাই) দিবাগত রাত ৯টার দিকে তাকে পোরশা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছিল। সোমবার সকালে চিকিৎসকেরা রোগীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। তারা প্রথমে তাকে নিয়ে সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। তার ভগ্নিপতির অবস্থার অবনতি হওয়ায় ডাক্তাররা তকে সেখানে ভর্তি না নিয়ে রাজশাহী নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন।
আলমগীর বলেন, তাঁদের পরিবারের পক্ষে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করাই কঠিন। তার ওপর দুই হাজার সাতশ’ টাকা দিয়ে হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে তাঁরা রোগী নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। তখন প্রায় দুপুর ১২টা বাজে। তাঁর সঙ্গে তাঁর বোন তানজিলা বেগম ও বোনের ছোট মেয়ে মরিয়ম খাতুন ছিল। অ্যাম্বুলেন্স থেকে তাঁর ভগ্নিপতিকে ট্রলিতে নামিয়ে রেখে তিনি ভর্তির জন্য টিকিট কাটেন। তারপর ফরমটি পূরণ করছিলেন। তাঁর ফরম পূরণ শেষ হওয়ার আগেই তাঁর বোন কেঁদে ওঠেন। তিনি তাড়াতাড়ি করে জরুরি বিভাগের চিকিৎসককে ডেকে আনেন। চিকিৎসক দেখে বলেন, রোগী মারা গেছেন।
এরপর আলমগীর হোসেন লাশ বাড়িতে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে যান। আর তাঁর বোন চিকিৎসকের কাছ থেকে কাগজ বুঝে নিচ্ছিলেন। এ সময় তার সাত বছর বয়সী ভাগ্নি মরিয়ম একাই ছিল। বাবাকে বাতাস করার জন্য বাড়ি থেকে একটি হাতপাখা আনা হয়েছিল। পাখাটি তখনো তার হাতেই ছিল। পাখা নিয়ে বাবার লাশের কাছে বসে ও কাঁদছিল। এই দৃশ্য দেখে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। রাজশাহীর সাংবাদিকেরা এই দৃশ্যটির ভিডিও ধারণ করে ফেসবুকে পোষ্ট দিলে তা ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি শিশু বাবার লাশ পাহারা দিচ্ছে আর ডুকরে কাঁদছে। ভিডিও ধারণকারী ওই ব্যক্তিকে ছোট বাচ্চা মেয়েটি জানায়, এক সপ্তাহ ধরে জ্বরের সঙ্গে কাশিতে ভুগছিলেন তার বাবা। সকালে হঠাৎ বুকে ব্যথা করলে হাসপাতালে নিয়ে আসেন পরিবারের লোকজন। সেখানে তার সামনেই মৃত্যু হয় তার বাবার।আলমগীর বলেন, হাসপাতালে শুধু নিয়েই যাওয়া হয়েছে। কোনো চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়নি। উল্টা আবার ছয় হাজার দুশ’ টাকা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে হলো। একশ’ টাকা চালককে বকশিশ দিতে হলো। আরও দুই হাজার টাকা আনুষঙ্গিক খরচ হলো। তিনি বলেন, তাঁর ভগ্নিপতির কোনো সঞ্চয় নেই। বাড়িভিটা ছাড়া কোনো জায়গাজমি নেই। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে তুষার আহাম্মেদ সবেমাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তিনি বলেন, এই খবর শুনে রাতেই নওগাঁর জেলা প্রশাসক পোরশা উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে তাদের বাড়ি পাঠিয়েছিলেন। তিনি দাফনের জন্য ১০ হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। তা দিয়েই সব ধারদেনা শোধ করেছেন। এখন ওপরে আল্লাহ ছাড়া এই পরিবারের আর কেউ নেই।
পোরশার ইউএনও নাজমুল হামিদ রেজা আহমেদ বলেন,‘ফেসবুকে বাবার লাশের পাশে বসে শিশুটির কান্না দেখে সবাই খুব কষ্ট পেয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটিকে আপাতত করোনাকালীন সহায়তা তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে ওই পরিবারের সদস্যরা আবেদন করলে সরকারের অন্যান্য সামাজিক বেষ্টনী সুবিধার মধ্যে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করে সহায়তা করা হবে।’
জেলা প্রশাসক হারুন অর রশিদ সাংবাদিকদের জানান, সকালে ভিডিওটি ফেসবুকে দেখার পর আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তাঁর বাড়ি খুঁজে বের করে পরিবারের খোঁজ-খবর নিতে বলি। পরে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মৃত মুজিবুর রহমানের বাড়ি খুঁজে বের করে তাঁর পরিবারের খোঁজ খবর নেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার।
তিনি আরো বলেন, মৃত ব্যক্তির পরিবারে স্ত্রী, ছোট দু’টি কন্যা সন্তান এবং ১০ বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। পরিবারটি অসহায় এবং আয়ের অন্য কোন উৎস না থাকায় তাৎক্ষণিক তাঁর স্ত্রী তানজিলার হাতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা ও একটি মুদি দোকান করে দেয়ার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে।#