প্রকাশের সময় :
০৮:২৯:৩৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ জুন ২০২১
১৪৬৮
Spread the love
মহাদেবপুর দর্পণ, কিউ, এম, সাঈদ টিটো, মহাদেবপুর (নওগাঁ), ২০ জুন ২০২১ :
নওগাঁর মহাদেবপুরে দিন দিন করোনার সংক্রমণ ও করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও করোনা প্রতিরোধে তেমন কোন সতর্কতা অবলম্বন করছেন না কেউ। মানা হচ্ছেনা জেলা প্রশাসকের জারী করা গণবিজ্ঞপ্তির নির্দেশনা। উপজেলা প্রশাসন বলছেন করোনা প্রতিরোধে ৯শ’ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। এছাড়া নিয়মিত পরিচালনা করা হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, রোববার (২০ জুন) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে ১২ জনের নমুনা পরীক্ষায় পাঁচজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে চারজন মহাদেবপুরের, আর একজন নিয়ামতপুরের। এছাড়া শনিবার (১৯ জুন) সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘন্টায় এই উপজেলায় করোনা আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
এসময় আক্রান্ত হয়েছেন ২১ জন। মৃত ব্যক্তির নাম আব্দুল গফুর (৬০)। তার বাড়ি উপজেলার রাইগাঁ ইউনিয়নের মাতাজীহাট এলাকায়। গত ১৭ জুন তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে নওগাঁ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শনিবার (১৯ জুন) তার অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এনিয়ে এই উপজেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৬ এ। গত ২৪ ঘন্টায় এই উপজেলায় ১৭ জনকে সুস্থ ঘোষণা করা হয়।
সূত্র জানায়, এই উপজেলায় এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩১৩ জন। মোট সুস্থ হয়েছেন ২০৪ জন। বর্তমানে আক্রান্ত রয়েছেন ১০৩ জন। এদের মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তিনজন স্টাফ এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাকিরা নিজ নিজ বাড়িতে রয়েছেন।
গত ৩ জুন থেকে নওগাঁ জেলায় কঠোর বিধিনিষেধ (লকডাউন) চলছে। ৩ জুন থেকে ৯ জুন, ১০ জুন থেকে ১৬ জুন, আর সবশেষ ১৭ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয় সে বিধিনিষেধ। নওগাঁ জেলা প্রশাসক স্বাক্ষরিত কঠোর বিধিনিষেধের গণবিজ্ঞপ্তির ১১নং দফায় বলা হয়, ‘‘নওগাঁ জেলাধীন কোন বাড়িতে কোভিড আক্রান্ত রোগী থাকলে উক্ত বাড়ি পুরোপুরি লকডাউন করতে হবে এবং ঐ বাড়ির সকল সদস্য লকডাউনে থাকবেন। সেক্ষেত্রে এধরনের বাড়ি বড় স্টিকার বা লাল পতাকা দ্বারা চিহ্নিত করতে হবে। একই পাড়া/মহল্লায় একাধিক বাড়িতে সংক্রমণ চিহ্নিত হলে উক্ত পাড়া/মহল্লা লকডাউন থাকবে।’’ কিন্তু জেলা প্রশাসকের সে নির্দেশনা মানা হচ্ছেনা মোটেও।
এই মূহুর্তে মহাদেবপুর উপজেলা সদরের প্রতিটি মহল্লায় করোনা আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। রোগী রয়েছেন, উপজেলা পরিষদের ১নং গেট সংলগ্ন এলাকায়, এশিয়া ব্যাংক সংলগ্ন এলাকায়, বকের মোড়ে, সোনার পট্টিতে, চেয়ারম্যান পাড়ায়, মাস্টার পাড়ায়, লাইব্রেরী পট্টিতে, দশকলোনী পাড়ায়, কলেজ পাড়ায়, লিচুতলায়, গ্রামীণ ব্যাংক এলাকায়, ঘোষপাড়ায়, দুলালপাড়ায়, ভোকেশনাল পাড়ায়, ফাজিলপুরে, নাটশালে, কুঞ্জবনে, মধুবনে, শিবগঞ্জের মোড়ে প্রভৃতি স্থানে।
উপজেলা সদরের যে কোন স্থানে পা রাখলে সেখানেই রয়েছে করোনা আক্রান্ত। অথচ সেসব এলাকায় কোন বাড়িই চিহ্নিত করা হয়নি। বাইরের কেউ জানতেই পারছেন না তিনি করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে চলে আসছেন। করোনা আক্রান্ত পরিবারের সদস্যরা তো লকডাউনে থাকছেনই না, বরং বেশীরভাগ ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্তরাও দিব্যি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
অভিযোগ করা হয়েছে যে, চাঁন্দাশ ইউনিয়নের মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক গ্রাম্য ডাক্তারের করোনা পজিটিভ হবার পরও প্রকাশ্যে চেম্বারে বসে রোগী দেখছেন। উপজেলার ভীমপুর ইউপি চেয়ারম্যান রামপ্রসাদ ভদ্রের ছেলে আপন ভদ্রের করোনাভাইরাস পজিটিভ রেজাল্ট আসার পরও তাদের বাড়ি লকডাউন করা হয়নি। চেয়ারম্যানও কোয়ারেনটাইনে যাননি। প্রতিদিন দিব্যি তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে সালিস দরবারে অংশ নিচ্ছেন, উপজেলায় আসছেন, চালিয়ে যাচ্ছেন তার ইউনিয়ন পরিষদের দৈনন্দিন কাজ। তার নিজের বা অন্য সদস্যদের নমুনা পরীক্ষাও করাননি।
তিনি জানান, তার ছেলের কোন উপসর্গ নাই। তাই পরীক্ষার রেজাল্ট ভূল হতে পারে। তাই তিনি এটাকে তেমন গুরুত্ব দেননি। অথচ তিনি কয়েকবার শ্রেষ্ঠ ইউপি চেয়ারম্যান হিসেবে রাষ্টপতির স্বর্ণপদক পেয়েছেন। পেয়েছেন এই বছরও। বিদেশও ভ্রমণ করেছেন।
গণবিজ্ঞপ্তির ১নং দফায় বলা হয়,‘‘নওগাঁ জেলায় সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দোকনপাট স্বাস্থ্যবিধি মেনে খোলা রাখা যাবে। মাস্ক পরিধান ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ব্যত্যয় হলে উক্ত মার্কেট/শপিং মল তাৎক্ষণিক বন্ধ করে দেয়া হবে। ওষধের দোকান স্বাস্থ্যবিধি মেনে সার্বক্ষণিক খোলা রাখা যাবে।’’ এই নির্দেশনায় সন্ধ্যা ৬টার পর ওষুধের দোকান ছাড়া অন্যসব দোকান বন্ধ রাখার বিধান রাখা হলেও তা মানা হচ্ছেনা। বরং সব ধরনের দোকানপাট গভীর রাত পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই খোলা রাখা হচ্ছে।
২নং দফায় বলা হয়,‘‘হোটেল রেস্তোরা শুধুমাত্র পার্সেল আকারে বা অনলাইনে অর্ডার গ্রহণপূর্বক বিক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। ফুটপাথ বা রাস্তার পাশের চায়ের দোকান খোলা রাখা যাবেনা।’’ এর কোনটিই মানা হচ্ছেনা। হোটেলগুলো পুরোপুরি খোলা। চায়ের দোকানগুলোও।
৪নং দফায় বলা হয়,‘‘অতীব জরুরী প্রয়োজন ব্যতিরেকে নওগাঁ জেলার কেউ সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে বের হতে পারবেন না। একান্ত প্রয়োজনে (ওষুধ ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) বের হতে হলে আইডি কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে।’’ এই বিষয়টি কেউ মানছেন না। কেউ দেখছেনও না।
৭নং দফায় বলা হয়েছে,‘‘সিএনজি ও অটোসমূহ শুধুমাত্র দুইজন যাত্রী নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করতে পারবে।’’ কিন্তু এগুলো চলছে পাঁচজন করে যাত্রী নিয়ে। এছাড়া মানা হচ্ছেনা সামাজিক অনুষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞা, মসজিদে ২০ জন মুসুল্লি নিয়ে নামাজের নির্দেশ। অনেক মসজিদে কোন মুসল্লিই মাস্ক ব্যবহার করেন না। এমনকি ইমাম, মোয়াজ্জিনও না। বেশীরভাগ মসজিদে দূরত্ব বজায় না রেখে গা ঘেঁষাঘেষি করে আগের মতই নামাজ আদায় করা হচ্ছে।
কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নির্দেশনা থাকলেও উপজেলার সর্বত্র চলছে রমরমা প্রাইভেট পড়ানো। কোমলমতি শিশুদের মুখে থাকছেনা মাস্ক। প্রতিটি স্কুল ও কোটিং সেন্টারে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে গাদাগাদি করে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে পাঠদান। হাটবাজারে যারা আসছেন তাদের ৯৫ ভাগের মুখেই মাস্ক নেই।
এসব বিষয়ে উপজেলা করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মিজানুর রহমান মিলন জানান, করোনা প্রতিরোধে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ৯শ’ স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছে। প্রতিটি ইউনিয়নে প্রতিটি ওয়ার্ড মেম্বারকে প্রধান করে ১০ সদস্য বিশিষ্ট ওয়ার্ড করোনা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিদিন কমিটির সদস্যরা নিজ নিজ এলাকায় মাস্ক বিতরণ, উদ্বুদ্ধকরণ ও সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। উপজেলা পর্যায়ে ট্যাগ অফিসাররা তাদের কাজ তদারকি করছেন। এছাড়া প্রতিদিন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। যারা মাস্ক ব্যবহার করছেন না, ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, গত শনিবার (১৯ জুন) মহাদেবপুর গরুহাটে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া মাস্ক বিতরণ, উদ্বুদ্ধকরণ প্রচারণায় ইউপি চেয়ারম্যানরা নিজেরাই অংশ নিচ্ছেন। উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা, থানা পুলিশ প্রতিদিন এসব কাজে অংশ নিচ্ছেন। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা আক্রান্তদের বাড়ি চিহ্নিত করছেন বলেও তিনি জানান।#