মহাদেবপুর দর্পণ, কিউ, এম, সাঈদ টিটো, মহাদেবপুর (নওগাঁ), ৪ অক্টোবর ২০২০ :
নওগাঁর মহাদেবপুরে ভূয়া এতিমখানা দেখিয়ে এতিমদের নামে ভাতা উত্তোলন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর একটি মাদ্রাসাকে এতিমখানা বানানোর পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। এতিমদের নামে বরাদ্দকরা ভাতা বৈধ করতে কমিটির লোকজন দৌড়ঝাপ শুরু করেছে। তৎপর হয়ে উঠেছে কর্তৃপক্ষও। গ্রামের যারা সাংবাদিকদের কাছে তথ্য দিয়েছেন তাদের নামে মামলা দায়েরেরও হুমকি দেয়া হয়েছে।
অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, উপজেলার হাতুড় ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলী তার মায়ের নামে “সমাসপুর মরহুমা সোনাভান খানম স্মৃতি বেসরকারী শিশু সদন’ নামে একটি এতিমখানার রেজিষ্ট্রেশন নেন। নওগাঁ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ওই এতিমখানার রেজিষ্ট্রেশন দেয়। রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ১১৫৯/২০১৬। চেয়ারম্যান ওই রেজিষ্ট্রেশন নেন অত্যন্ত গোপনে এবং সংশ্লিষ্ট কর্র্র্তৃপক্ষ প্রকৃত অবস্থা যাচাই না করেই এর রেজিষ্ট্রেশন দেয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, সমাসপুর গ্রামে বিভিন্ন মানুষের দান করা সম্পত্তির উপর ২০০৪ সালে “সমাসপুর ফোরকানীয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও শিশু সদন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুরু থেকেই মাদ্রাসার প্রবেশদ্বারে ওই নামে সাইনবোর্ড রয়েছে। এই একটি শিশু সদন ছাড়া আর কোন শিশু সদন ওই গ্রামে নেই। ওই প্রতিষ্ঠানে তিন কক্ষ বিশিষ্ট আধাপাকা ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে ১৫ জন শিক্ষার্থী এখানে অধ্যয়নরত রয়েছে। গ্রামের লোকেরা পালা করে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু শিশু সদনটির রেজিষ্ট্রেশন নেয়া হয়নি।
ওই মাদ্রাসায় সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলীও ৫ শতক সম্পত্তি দান করেন। এরই সুবাদে তিনি তার মায়ের নামে রেজিষ্ট্রেশন নেয়া শিশু সদনটি ওই মাদ্রাসা ভবনেই রয়েছে বলে কাগজে কলমে দেখান। কিন্তু সেখানে আগে থেকেই আরও একটি শিশু সদনের অস্তিত্ব যে ছিল তা তিনি গোপন করেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রেজিষ্ট্রেশন দেয়ার সময় আগের শিশু সদনটিকে আমলে না নিয়ে নতুন নামে রেজিষ্ট্রেশন দেয়। রেজিষ্ট্রেশন হলেও বিষয়টি গোপন রাখার জন্য গত ৪ বছরেও নতুন নামে কোন সাইনবোর্ড লাগানো হয়নি।
সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলী অসুস্থ্য হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
হাতুড় ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক বলেন, “সমাসপুর মরহুমা সোনাভান খানম স্মৃতি বেসরকারী শিশু সদন’ নামে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। তবে এসংক্রান্ত খবর ছাপা হবার পর কয়েকজন ব্যক্তি এতিম শিশুদের প্রত্যয়নপত্র নিতে তার কাছে এসেছিলেন। প্রকৃত এতিম না হওয়ায় তিনি প্রত্যয়ন দেননি বলে জানান।
ওই ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ¦ আব্দুল মতিন মন্ডল জানান, ওই নামে কখনো কোন প্রতিষ্ঠান ছিলনা।
রেজিষ্ট্রেশন দেয়ার পরপরই ২০১৭-’১৮ অর্থবছরে কথিত “সমাসপুর মরহুমা সোনাভান খানম স্মৃতি বেসরকারী শিশু সদন’ এর ৪ জন এতিমের নামে ক্যাপিটেশন গ্রান্ট (সরকারি অনুদান) বাবদ ২৪ হাজার টাকা এবং পরের অর্থবছরে ৪৮ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। এছাড়া গত অর্থবছরে ৬ জন এতিমের নামে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়।
সমাসপুর ফোরকানীয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও শিশু সদনের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমিন বাবু জানান, তিনি ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। এসময় ২৪ হাজার টাকা সরকারী অনুদান দেয়া হয়। ওই মাদ্রাসার ক্যাশিয়ার ও সাবেক চেয়ারম্যান আকবর আলীর ভাতিজা আতাউর রহমান বলেন, সরকারি অনুদানের টাকা মাদ্রাসার শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন বাবদ খরচ করা হয়েছে। ওই গ্রামের আরিফুল আলম, মোকসেদ আলী প্রমুখ জানান, মাদ্রাসার ছাত্রদের গ্রামের লোকজন খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন এবং মাদ্রাসায় দান করা সম্পত্তির ফসল থেকে শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন পরিশোধ করা হয়। সরকারি অনুদানের টাকা কখন উত্তোলন করা হয়, কি খাতে ব্যয় করা হয় তা গ্রামের কাউকে জানানো হয়না। এছাড়া এতিমদের নামে বরাদ্দ করা টাকা তাদেরকে না দিয়ে বেতন বাবদ খরচ করা বৈধ নয় বলেও তারা মন্তব্য করেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে একদল সাংবাদিক সমাসপুর গ্রামে গিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখেও ওই নামে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। গ্রামের বৃদ্ধ মানুষেরাও ওই নামে কোন এতিমখানার নাম শোনেননি বলে জানান।
ওই গ্রামের একমাত্র সমাসপুর ফোরকানীয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও শিশু সদনে গিয়ে কয়েকজন শিশুকে দেখা যায়। তারা জানায়, এখানে মোট ১৫ জন লেখাপড়া করে। এদের মধ্যে সাজেদুল ও শামীম নামে ২ জন এতিম রয়েছে। এখানে ৬ জন এতিম থাকার কথা ঠিক নয় বলেও তারা জানায়। ক্যাশিয়ার আতাউর রহমান জানান, বাকী ৪ জন করোনার কারণে অনুপস্থিত রয়েছে। কিন্তু তাদের নাম ঠিকানা তিনি বলতে পারেননি।
মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী পরিচয় দানকারী জাহিরুল ইসলাম জানান, মাদ্রাসাকেই “সমাসপুর মরহুমা সোনাভান খানম স্মৃতি বেসরকারী শিশু সদন’ হিসেবে চালানো হচ্ছে।
এলাকার কয়েকজন অভিযোগ করেন যে, সাংবাদিকেরা সরেজমিনে মাদ্রাসা পরিদর্শনের সময় লাইভ ভিডিওতে যারা বক্তব্য দিয়েছেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাদের নামে মামলা দায়েরের হুমকি দিয়েছেন।
সংবাদ প্রকাশের পর উপজেলা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সাংবাদিকেরা ভূয়া তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে তিনি সরেজমিনে বিষয়টি তদন্ত করেছেন।
কথিত “সমাসপুর মরহুমা সোনাভান খানম স্মৃতি বেসরকারী শিশু সদন’ এর সরকারি বরাদ্দের তালিকায় যোগাযোগের ঠিকানায় কমিটির সভাপতির ফোন নম্বরের পরিবর্তে উপজেলা সমাজসেবা অফিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হারুন অর রশিদের ব্যক্তিগত ব্যবহৃত মোবাইলফোন নম্বর দেয়া থাকায় এলাকায় ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে। একটি অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের জন্য তার মোবাইল নম্বর কেন ব্যবহার করা হয়েছে তার কোন সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি। স্থানীয় সুধীমহলের মতে হারুনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ভূয়া প্রতিষ্ঠানের নাম ও তার নিজের মোবাইলফোন নম্বর ব্যবহার করে এতিমদের নামে ভাতা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হচ্ছে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্তকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ প্রাংয়ের কাছে এবিষয়ে বার বার জানতে চাইলেও তিনি এসবের কোন উত্তর দিতে রাজী হননি। এব্যাপারে সাংবাদিকেরা তথ্য অধিকার আইনে নির্ধারিত ফরমে তথ্যের আবেদন করলে তিনি সে আবেদন গ্রহণেও অস্বীকার করেন। পরে সাংবাদিকেরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট সে আবেদন জানান।
ইউএনও মিজানুর রহমান তথ্য অধিকার আইনে তথ্যের আবেদন পাবার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, এব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদনটি তিনি উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার নিকট পাঠিয়েছেন।
জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নূর মোহাম্মদ বলেন, আগে কি হয়েছে তা দেখার এখতিয়ার তাদের নেই। রেজিষ্ট্রেশন পাবার পর থেকে কি হচ্ছে তা তারা তদন্ত করে দেখছেন। ইতিপূর্বে প্রকাশিত সংবাদ উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।#